বাঘ

প্রচণ্ড শীতে থরথর করে কাঁপছে রতন। গায়ে চাদর আছে, পাশে বেশ বড় করে আগুন জ্বালিয়েছে কিন্তু এতসব আয়োজন করেও মাঘ মাসের এই প্রচণ্ড শীতকে বশে আনা যাচ্ছেনা। রতন নিরালা আবাসিক এলাকার নাইট গার্ড। অল্প কিছুদিনআগে সে এই চাকরিটা নিয়েছে কিংবা বলা যায় নিতে বাধ্য হয়েছে। খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্য কিছু একটা তো করতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে এই চাকরিটা নিয়েছে। মোটেই সুখকর কোন চাকরিনা এটা। সারারাত ধরে ঘুমের বারোটাবাজিয়ে জেগে থাকতে তো হয়ই, তার উপর গত কিছুদিন ধরে যুক্ত হয়েছে বাঘের ভয়। গত পাঁচদিন হলো খুলনা শহরে প্রতি রাতে একটা করে লাশ পাওয়া গেছে। প্রতিটা লাশ পাওয়াগেছে ক্ষত বিক্ষত অবস্থায়। যেন কোন হিংস্রজন্তু প্রচণ্ড আক্রোশে ছিঁড়ে কামড়ে একাকার করেছে লাশগুলোকে। পেপারে এনিয়ে প্রতিদিন লেখালিখি হচ্ছে। ডাক্তারদের মতে কোন মানুষের পক্ষে এভাবে হত্যা করা সম্ভব না। শুধুমাত্র বুনো কিছু হিংস্র প্রাণী, যেমন- বাঘ,সিংহ, নেকড়ে বা হায়না এইধরনের প্রাণীর পক্ষেই এভাবেহত্যা করা সম্ভব। খুলনা কেন সারা বাংলাদেশের কোন বনেই সিংহ, নেকড়ে বা হায়না নেই। কিন্তু বাঘ আছে, এই খুলনার সুন্দরবনেই। ডাক্তারদের এই মতের উপর ভিত্তি করে সারা খুলনা শহর চষে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কোথাও বাঘের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে বাঘেরপায়ের ছাপ পাওয়া গেছে।হতভাগ্য লাশগুলোর আশেপাশেই বাঘের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। 

সুন্দরবন থেকে বিশাল ভৈরবনদী পার হয়ে খুলনা শহরে ঢোকা কোন বাঘের পক্ষে সম্ভব না। আর যদি কোনভাবে ঢুকেও থাকেতাহলে কোথায় লুকিয়ে থাকছে বাঘটা, সেটা এখন পর্যন্ত বের করাসম্ভব হয়নি। রাততো দূরেরকথা, মানুষ এখন দিনের বেলাতেও ঘরের বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছে। গতকাল রতন একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল। চায়ের দোকানের মালিক কাদের ভাইয়ের দেশের বাড়ি সুন্দরবনের পাশেই কোন গ্রামে। সেখানে একটা গল্পপ্রচলিত আছে, সুন্দরবনের মির্জা বাড়ি এলাকায় অনেক আগে মির্জা আসাদ ওয়ালি নামে এক জমিদার বাস করতেন। একটা পোষা বাঘছিল তার। বাঘটার হিংস্রতাবাড়ানোর জন্য প্রায়ই তাকে অল্প খাবার দেয়া হত। একদিন কোনোভাবে বাঘটাখাঁচা থেকে বের হয়ে আসে।দুর্ভাগ্যক্রমে জমিদার তখন তার বাগানে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। অভুক্ত বাঘটা ক্ষুধার জ্বালায় তার মনিবকেইআক্রমণ করে বসে। । জমিদারেরভাগ্য ভালো, মারা যাননি তিনি কিন্তু গুরুতর ভাবে আহত হন। মির্জা আসাদ ওয়ালি যেদিন আহত হন, সে রাতেই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। কথিত আছে এর পর থেকে প্রতি রাতে আকাশে চাঁদ উঠার পর থেকে তিনি বাঘের রূপ ধারণ করেন এবং প্রতিরাতেই একটা না একটা খুন করেন। মির্জা আসাদ ওয়ালিআহত হবার পর থেকে প্রতি রাতেই একজন করে গ্রামবাসিমায়া বাঘের আক্রমণে মারাযেতে থাকল। গ্রামের মানুষরা মায়া বাঘের ভয়েএকে একে গ্রাম ত্যাগ করতেলাগল। ধীরে ধীরে পুরো গ্রাম জনশুন্য হয়ে গেল। কথিত আছে আজও সেই মায়া বাঘ মির্জা বাড়ির আসে পাশে ঘুরে বেড়ায়। আজও সুন্দরবনের আশেপাশের গ্রামের মানুষ প্রায় রাতেই সেই মায়া বাঘের রক্তহিম করা গর্জন শুনতে পায়। কাদের ভাইয়ের মতে মির্জা আসাদ ওয়ালি রূপী সেই বাঘটা আজ প্রায় একশ বছর পর জঙ্গল ছেড়ে শহরে চলে এসেছেন। দিনের বেলায়মানুষরূপে থাকলেও রাতে তিনি বাঘের রূপ ধারণ করে একের পর এক হত্যা করে চলেছেন। রতন জানে এটা কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু বাঘতো একটা আছেই, যেটা প্রতি রাতে নির্মম ভাবে একটার পর একটা হত্যা করে চলেছে। আবার কেঁপে উঠল রতন। শীতেনা ভয়ে তা নিজেও ঠিক বুঝতে পারল না। হঠাৎ পিছনে একটা শব্দ শুনে চমকে ঘুরে তাকাল। নাইটগার্ডের ইউনিফরম পরা একজন লোক ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিরাতে দুজন করে নাইটগার্ড এই এলাকা পাহারা দেয়। এই লোকটাকে ও আগেকখনও দেখেনি। নতুন বোধহয়। লোকটা একটু হেসে রতনের পাশে এসে বসল। “নতুন নাকি? কবে জয়েন করলা”, রতন জিজ্ঞেস করল।বিদঘুটে ভাবে একটু হাসল লোকটা। “আজকেই”, বলল লোকটা। “নাম কি?” “জলিল” “ঘটনা শুনছ নাকি?”একটু উদাস ভাবে জিজ্ঞেসকরল রতন। “কি ঘটনা?” চোখ দুটো সরু করে জিজ্ঞেস করল জলিল । নিজে পুরোপুরি বিশ্বাস নাকরলেও কাদের ভাইয়ের কাছেশোনা ঘটনাটা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য করে বলে গেলরতন।কিছু কথা বানিয়ে যোগ করতেও ভুললনা। গল্প বলা শেষ করে লোকটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল রতন। হিংস্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। “আপনি এইসব বিশ্বাস করেন”, রাগত স্বরে জিজ্ঞাসা করল সে। “বিশ্বাস না করার কিছুই নাই, অনেক আজব ঘটনা ঘটে এইদুনিয়ায়”, দার্শনিকের মত জবাব দেয় রতন, লোকটাকেভড়কে দিতে পেরে মনে মনে খুশি হয়েছেসে। ক্রূর হাসি হাসল জলিল । চোখদুটো যেন মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠল। “ঠিকই বলেছেন অনেক আজব ঘটনা ঘটে এই দুনিয়ায়। যেমায়া বাঘের কথা আপনি ভাবছেন সে হয়তো আপনার আশেপাশেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে কিংবা মানুষ রূপে আপনার সামনেই রয়েছে, আপনি হয়তো বুঝতেও পারছেন না”, ধ্বক করে জ্বলে উঠল জলিলের চোখজোড়া। ভয়ের একটা শীতল শিহরন বয়ে গেল রতনের মেরুদণ্ড বেয়ে। একটা অশুভ চিন্তা উঁকি দিচ্ছে মনের ভিতরে। সত্যি না তো কাদের ভাইয়ের কাছে শোনা ঘটনাটা? হয়তো সত্যিই কোনমায়া বাঘ আছে, হয়তো মির্জা আসাদ ওয়ালিনামে সত্যিই কারও অস্তিত্ব আছেযে শহরে এসে প্রতি রাতে নির্মম ভাবে একটার পর একটা হত্যা করছে। জলিলের দিকে তাকাল রতন। কি যেন একটা অশুভ ব্যাপার আছে লোকটার চোখদুটোতে। হঠাৎ মনের মধ্যে উঁকি দিলভয়ংকর চিন্তাটা, বুঝতে পারল কি ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আছে সে। আবার জলিলের দিকে অকাল রতন। এখনও সেই ভয়ংকর হাসিটা লেগে আছে জলিলের ঠোঁটে। “তাহলে এতক্ষণেচিনতে পারলে আমি কে?”, বাজ পরল যেন লোকটার কন্ঠ থেকে। ঢোক গিলল রতন। বুঝতে পারছে কাদের ভাইয়ের কাছেশোনা গল্পটা মোটেও বানোয়াট না। কিন্তু বুঝেও আর কোন লাভ নাই, মৃত্যু ওর থেকে মাত্র দুইফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
আবার বিশ্রী করে হেসে উঠলজলিল,কিন্তু এবারের হাসিটা আর ভয়ংকর শোনাল না বরং মনে হল কিছুটা ব্যঙ্গ করে হাসছে জলিল । অবাক হয়ে তাকাল রতন। জলিলেরহাসি যেন থামতেই চায়না। হাসির দমকে চোখ দিয়ে পানি বেরহয়ে আসছে।“আপনি...আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন। আপনি তো দেখি মিয়া ভয়ে প্যান্ট খারাপ করে ফেলেছেন”, হাসতে হাসতে বললো জলিল। এতক্ষণে রতন আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারল। লোকটা এতক্ষণ যা বলেছে সবমিথ্যা। রাগ হল রতনের। কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। “তুমি কি মনে করেছ, তুমি যা বলছআমি তা বিশ্বাস করেছি? তোমার একটা কথাও আমি বিশ্বাস করিনি। শুধুমাত্র ভয়ের অভিনয় করেছি।” জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল রতন। খ্যাঁক খ্যাঁক করে আবার হেসে উঠল জলিল। বুঝিয়ে দিল রতনের কথা সে বিশ্বাসকরছে না। “আমি তোমার কথা এক বর্ণও বিশ্বাস করিনি”, ঝিক করে জ্বলে উঠল রতনের চোখ জোড়া, “আমি প্রথম থেকেই জানি তুমি মিথ্যা কথা বলছ,তুমি মায়া বাঘ না”। “আচ্ছা, তো কি করে বুঝতে পারলেন আমি মায়া বাঘ না”জিজ্ঞসা করল জলিল। “ আমি জানি তুমি মায়া বাঘ না”, ঘরঘর করে উঠল রতনের কন্ঠস্বর, “কারণমায়া বাঘ আমি নিজেই।” অবিশ্বাস ভরে রতনের দিকে তাকাল জলিল । হঠাৎ ধ্বক করে জ্বলে উঠল রতনের চোখ জোড়া, চোখ তুলেতাকাল পূর্ণিমার বিশাল চাঁদটার দিকে। ঘনঘন নিশ্বাস নিতে শুরু করল, যাঅতি দ্রুত রূপান্তরিত হল চাপা গোঙানিতে। চোখের কালো মণি বদলে গিয়ে হলুদরং ধারণ করল। হলুদ হয়ে উঠল চামড়া, শরীর ফুঁড়ে বেরুতে শুরু করল থোকা থোকা লোম। কান দুটো আকারেবড় হয়ে উঠল। ফাঁক হয়ে গেল রতনেরমুখটা, চোয়ালে ঝিকিয়ে উঠল ক্ষুরধার দাঁতের সারি। রূপান্তরের যন্ত্রণায় হাত দিয়ে মাটি খামচে ধরল রতন, চোখেরনিমিষেই ও দুটো পরিণত হল বিশাল রোমশ থাবায়। ধীরে ধীরে রতন পরিণত হল এক বিরাট রয়েল বেঙ্গল টাইগারে। বিকট এক গর্জন ছেড়ে জলিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লবাঘরূপী রতন ওরফে এককালেরপ্রতাপশালী জমিদার, মির্জা আসাদ ওয়ালি। আগুনটা একটু উস্‌কে দিল রতন। শীতটা যেন আজকে একটুবেশীই পরেছে। হঠাৎ পিছনে একটা শব্দ শুনে চমকে ঘুরেতাকাল। নাইটগার্ডের ইউনিফরম পরা একজনলোক ঠিকতার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।লোকটা একটু হেসে রতনের পাশে এসে বসল। “নতুন জয়েন করলা মনেহয়”একটু হেসে বলল রতন। “আজকেই”, প্রত্যুত্তরে বলল লোকটা। “নাম কি?” “ইদরিস।”“ঘটনা শুনছ নাকি?”, একটু উদাস ভাবে জিজ্ঞাসা করল রতন। “কি ঘটনা?”, জিজ্ঞাসা করল লোকটা। কাদের ভাইয়ের কাছে শোনা ঘটনাটা বলতে শুরু করল রতন।

Disclaimer: Gambar, artikel ataupun video yang ada di web ini terkadang berasal dari berbagai sumber media lain. Hak Cipta sepenuhnya dipegang oleh sumber tersebut. Jika ada masalah terkait hal ini, Anda dapat menghubungi kami disini.
Disqus Comments