মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের এমএইচ১৪৪৬ ফ্লাইটটি লাংকাউই মাটি ছুঁলো ঠিক বিকেল চারটায়। কুয়ালালামপুর থেকে এক ঘন্টার বিমান যাত্রায় পৌঁছে গেলাম লাংকাউই। প্লেন থেকে নেমেই গা ছম ছম করা অনুভূতি। অন্য বিমান বন্দরগুলো থেকে এই এয়ারপোর্ট যেন ঠিক একেবারেই আলাদা। এয়ারপোর্টের চারপাশে তাকিয়ে যে জৌলুস চোখে পড়ে তা নেই এখানে। অরণ্য, পর্বত আর সাগরের মাঝখানে অবলীলায় নেমে গেলাম আমরা প্রায় তিনশ’ ট্যুরিস্ট। আমি যদি দৃষ্টিপাতের লেখক যাযাবরের মতো বাংলা লিখতে পারতাম তবে লাংকাউই বিমান বন্দরটিকে উইলিংডন এয়ারপোর্টের সাথে তুলনা করতে পারতাম। কিন্তু আমার বাংলা লেখার গাঁথুনি অতো শক্ত নয়। তাই অমন করে বর্ণনা করা আমার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। যাযাবর (বিনয় মুখোপাধ্যায়) তার দৃষ্টিপাতে লিখেছেন উইলিংডন এয়ারপোর্টটি বৃহৎ নয়। কিন্তু গুরুত্বে প্রধান, সংবাদপত্রে এর বহুল উল্লেখ। একথাটা লাংকাউই এয়ারপোর্টের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। ছোট্ট একটা দ্বীপের সাদামাটা একটা এয়ারপোর্ট। কিন্তু লাংকাউইয়ের গুণগান সকলের মুখে মুখে। লাংকাউই শুধু এশিয়ার নয় পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্যুরিস্ট স্পট। এখানে কোন ইমিগ্রেশন নেই কারণ আমরা একই দেশে ভ্রমণ করছি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। ছোট্ট এয়ারপোর্টের মূল ভবনে এসে এবার ভালো করে আমাদের সহযাত্রীদের মুখগুলোর দিকে একবার তাকালাম। প্রায় সবার চেহারাই ইউরোপীয় ধাঁচের। হাতে গোনা কয়েকজন চায়নিজ। অর্থাৎ বুঝাই গেল আমরা সবাই ট্যুরিস্ট। নিছক ভ্রমণের অভিপ্রায়েই আমরা সবাই এখানে এসেছি। ভ্রমণ ছাড়া অন্য কোন কাজে মানুষ লাংকাউই আসবেই বা কেন? ডিপারচার অর্থাৎ নির্গমন গেটের দিকে চাইতেই দেখলাম একজন নারীর বিশাল পোট্রেট সামনের দেয়ালে। বুঝতে চেষ্টা করলাম এই রমণীটি কে। জাতীয় পর্যায়ে কোন বিখ্যাত নারী ছাড়া এখানে কোন পোট্রেট থাকার কথা নয়। ছবিটির সামনে এগিয়ে গেলাম আমি আর আমার মেয়ে অনি। অন্য ট্যুরিস্টরা যে যার মতো বেরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কোন তাড়া নেই। আর অজানাকে জানার জন্যই এই দ্বীপে এসেছি, যে দ্বীপটিকে তাবৎ চরাচর থেকে আলাদা বলেই অনুমান হয়। আমি আর অনি বেশ কিছুক্ষণ পোট্রেটটির নিচে এবং আশেপাশে মেয়েটির নাম অথবা পরিচিতি খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোথাও তার পরিচয় লেখা নেই। লোকালয় থেকে তেপান্তরে এসে হঠাৎ কোন নারীকে চেনাও প্রায় অসাধ্য। ব্যাংকক শহরে যদি আপনি ট্যাক্সিতে এক চক্কর দেন তবে দেখবেন প্রতিটি হাইরাইজ ভবনে রাজা-রানীর যুগল কিংবা একক পোট্রেট লাগানো আছে। রাজকীয় ঢং-এর পোট্রেট। দেখলেই বুঝা যায় এটি রানী কিংবা রাজকুমারী। কিন্তু যে পোট্রেটটির সামনে আমরা দাঁড়ালাম তাকে অতি সাধারণ নারী বলে অনুমান হয়। একে রাজকুমারী ভাবার কোন অবকাশ নেই। ব্যর্থ হয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এলাম। কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম মেয়েটির পরিচয়। কিন্তু শুরুতেই এতো অনুসন্ধিৎসা দৃষ্টিকটু বলে মনে হলো। যখন ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছি তখন সুদি বললো ঐ মেয়েটির আরো। বেশ ক’টি ছবি আছে আশেপাশে। অনি বললো, মেয়েটি নিশ্চয়ই এই দ্বীপের কোন নামকরা হিরোইন অথবা মডেল। তাই তার ছবি সব জায়গায় ডিসপ্লে করা হয়েছে।
তবে আমার মনে খটকা লেগেই থাকলো। কারণ মেয়েটির বেশভূষা মোটেই মডেল কিংবা নায়িকাদের মতো নয়। তবে ইচ্ছা থাকলো পরে এই নারীর রহস্যটি উদঘাটন করতে হবে। ট্যাক্সিতে উঠলাম আমরা চারজন। হোটেল বুকিং করা আছে আগে থেকেই। আমরা যখনই বিদেশে ভ্রমণ করি, তখন সব সময়ই আমাদের ভ্রমণ সঙ্গী মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন। যেখানেই আমাদের ডেসটিনেশন হোক না কেন আমাদের যাওয়া আসা সব সময় কুয়ালালামপুর দিয়ে। মাত্র দুদিন আগেই আমরা কুয়ালালামপুর এসে পৌঁছেছি সিডনি থেকে। কেএল’এ এক রাত থেকে আজ এসেছি লাংকাউইতে। সিডনিতে ডাক্তারি কনফারেন্স থাকলেও লাংকাউইতে এসেছি নিছক ভ্রমণে। আমাদের মালয়েশিয়া ভ্রমণের ইটিনারারি ঠিক করে দিয়েছেন মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের ঢাকা অফিসের বিপ্লব চক্রবর্তী। প্রতিবারই কম ভাড়ায় বিমান টিকেট এবং কম দামে ফাইভ স্টার হোটেলে থাকার ব্যবস্থা বিপ্লব দা’ই করেন। লাভ শুধু এটুকুই না, বিপ্লব দার বদন্যতায় ইকোনোমি ক্লাসের টিকিট কেটে আমরা বিজনেস ক্লাসেও ভ্রমণ করেছি দু একবার। বিজনেস ক্লাসে সিটখালি থাকলেই আমাদের টিকিটটা আপগ্রেডেড হয়ে যায় অবলীলায়। এতো সুযোগ দেয়ায় আমরাও অন্য এয়ারলাইনের দিকে ঝুঁকি না। এবারও ঠিক একইভাবে ভ্রমণে বের হয়েছি। লাংকাউই হোটেল বুকিং-এর ভাউচার আমাদের সাথে।
কোনদিন এতো নির্জন দ্বীপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। এদেশটা যদি মালয়েশিয়া না হতো তবে হয়তো ভয়ই লাগতো। কারণ মালয়েশিয়ার প্রায় সব ট্যুরিস্ট স্পটই আমাদের দেখা। এশিয়ান কিংবা ওয়েষ্টার্ন সব কিছুই আছে এ দেশটিতে। কিন্তু তার সাথে আছে নিèিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তাই সারা দুনিয়ার ট্যুরিস্টরা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায় মালয়েশিয়ার প্রত্যন্ত এলাকায়। কোন ট্যুরিস্ট স্পটে যদি নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর না হয় তবে সে দেশে কোন ট্যুরিস্ট যাবে না কখনো। সেই দিক থেকে মালয়েশিয়ার সাফল্য একশতে একশ। ট্যাক্সিতে উঠেই ড্রাইভারকে বললাম, হলিডে ভিলা বীচ রিসোর্টে যেতে কতোক্ষণ লাগবে। ড্রাইভার জানালো পৌনে এক ঘন্টার মধ্যে আমরা পৌঁছে যাবো হোটেলে। হোটেলের নামই বীচ রিসোর্ট। অর্থাৎ বুঝতেই পারলাম সমুদ্রের পাড় ঘেঁষেই হবে আমাদের লাংকাউইর নিবাস। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই বুঝলাম, এটি জনশূন্য একটি প্রত্যন্ত দ্বীপ, যাকে সমগ্র চরাচর থেকে বিচ্ছিন্ন বলেই বিভ্রম হয়। হয় পাহাড় না হয়তো সাগরের পাশ ঘেঁষে আমাদের গাড়ি শাঁ শাঁ করে এগিয়ে যাচ্ছে হলিডে-ইন ভিলার দিকে। আশপাশে সমুদ্র সৈকতের ছড়াছড়ি। গোয়া কিংবা আমেরিকার মাওয়ি দ্বীপের সাথে লাংকাউই’র মিল রয়েছে অনেকাংশে। দূর থেকে দেখে মনে হলো মাওয়ি’র বিশ্ববিখ্যাত পাপালুয়া, কাপালনি, কাহানা কিংবা কাপালুয়া বীচের চাইতে লাংকাউই’র সৈকতগুলো কোন অংশে কম সুন্দর নয়। প্রায় দেড় যুগ আগে মাওয়ি’র কাপালুয়া বীচের পাড়ে এক রিসোর্টে আমি থেকে এসেছি এক সপ্তাহ। পাহাড়ের ওপরের হোটেল কিংবা সৈকত লাগোয়া রিসোর্টে রাত্রি যাপনের অভিজ্ঞতা সবসময়ই রোমাঞ্চকর।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট্ট একটা শহরের উপস্থিতি টের পেলাম। বলা যায় একদম বিরান ভূমি থেকে জনারণ্যে প্রবেশ করলাম। সমুদ্রের পাশ ঘেঁষে চলতেই হঠাৎ চোখে পড়লো একটি বিশাল রিসোর্ট। চোখ ফেরাতেই দেখলাম গেটে লেখা হলিডে ভিলা বীচ রিসোর্ট ও স্পা। বুঝতে পারলাম হোটেলে পৌঁছে গেছি। গাড়ি থেকে নেমেই বুঝলাম এ হোটেলের আদব-কায়দা ট্র্যাডিশনাল। অর্থাৎ অন্য পাঁচ তারকা হোটেলের সাথে এর কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। বুঝা গেল, এ দ্বীপের ঐতিহ্যগত ভাবধারায় গড়ে তোলা হয়েছে এই রিসোর্টটিকে। হোটেল রিসেপশনে এসে আমাদের ভাউচারটি দিলাম। প্রত্যেক হোটেল কাউন্টারে যেয়ে আমি সচরাচর যে কথাটি সব সময় রিসেপশনিষ্টকে বলি সেই কথাটি এখানেও বললাম। অর্থাৎ আমি অভ্যর্থনাকারিনীকে অনুরোধ করলাম যাতে সে যতোটা সম্ভব উঁচু ফ্লোরে আমাদের রুমটির বরাদ্দ দেয়। কারণ কুড়ি তলা কিংবা পঁচিশ তলা হোটেলের জানালা দিয়ে রাতের অচেনা শহরগুলোকে স্বপ্নের মত লাগে। গতকাল রাতেই থেকে এসেছি কুয়ালালামপুরের জালান ইসমাইল রোডের রেনেসাঁ হোটেলের তেইশতম ফ্লোরের একটি ডিলাক্স রুমে। রেনেসাঁ হোটেলের জানালা দিয়ে চাইলে মনে হয় হয়তো হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে টুইন টাওয়ার। তারকা হোটেলের উঁচু তলায় থাকার ব্যাঞ্জনাই আলাদা। তাই লাংকাউই এসেও উঁচু ফ্লোরে থাকার বায়না ধরলাম রিসেপশনিষ্টের কাছে। আমাদের যাঞ্চা শুনে অভ্যর্থনাকারিনীকে একটু অবাক হতে দেখলাম। সহাস্যে পুতুলের মতো চায়নীজ মেয়েটি বললো, আমাদের হোটেলে তো হাইরাইজ ফ্লোর নেই। আমাদের হোটেলটিই তো মাত্র দোতলা। অর্থাৎ হাইরাইজ বলতে সেকেন্ড ফ্লোর। মনে মনে লজ্জা পেলাম এই ভেবে, যে হোটেলে এসেছি সেই হোটেল সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। যদি নিজে কখনো ইন্টারনেটে হোটেল বুক করি তবে তখন হোটেলের রুম সংখ্যা, হোটেলটি কতো তলা কিংবা ব্রেকফাস্ট ফ্রি কিনা এসব বিষয়-আশয়গুলো ভালো মতো দেখে নেই। কিন্তু এবারের ভ্রমণে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। আমাদের হোটেল বুকিং, সাইট সিটিং সবকিছু ঠিক করে দিয়েছেন বিপ্লব দা মালয়েশিয়ান এয়ার লাইনের প্যাকেজের ভেতর। তাই হোটেল সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার দরকার হয়নি। মেয়েটি আমাকে হেসে জানালো, উঁচু তলাতে থাকতে পারবো না কিন্তু ঘর থেকে হাত বাড়ালেই সমুদ্রের জল ছুঁতে পারবো। হোটেলের লবিটি এমন ঢং-এ বানানো যে, সেখানে দাঁড়িয়ে কারু পক্ষেই বুঝা সম্ভব নয় হোটেলটি কতো বড় এবং এটি কতো তলা হোটেল। হলিডে ভিলার রুম খুলেই আমার বৌ চন্দনার মুখে চাঁদের হাসি। এমন দৃশ্য কোথায় গেলে আর দেখা যাবে? ঠিক যেন রুমের দোরগোড়ায় সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। লবিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ফোঁপানি শোনা যায়নি। কিন্তু এখন তা স্পষ্ট। পানটাই তেনঘা সী বীচের ওপর চৌদ্দ একর জমির উপর গড়ে উঠেছে এই হোটেল। হোটেলটি গড়ে তোলা হয়েছে গ্রামের আদলে। লাংকাউই দ্বীপের পশ্চিম উপকূলে এটি একটি পশ রিসোর্ট। তিনশ আধুনিক রুমের এক বিশাল সমাহার এই রিসোর্টে। আমাদের রুমের ঠিক সামনেই বিশাল সুইমিংপুল, আর তার পাশ ঘিরে তিনটি লন টেনিস কোর্ট। জামা কাপড় পাল্টে বেরিয়ে গেলাম হোটেল পর্যবেক্ষণে। অনি-সুদি দুজনেই চাইছিল সুইমিংপুলে নামতে। কিন্তু চন্দনার আপত্তিতে তা হলো না। তখন চারদিকে আঁধার নামছে গুঁড়ি গুঁড়ি। সন্ধ্যায় সাঁতরালে যদি ঠান্ডা লাগে, সেই ভয়ে কাউকেই সুইমিংপুলে যেতে দেয়া হলো না। লবিতে নেমে হোটেলের চারপাশ ভাল মতো পর্যবেক্ষণ করলাম বেশ কিছুক্ষণ। বুঝতে পারলাম লাংকাউই শহর থেকে এই রিসোর্টটি প্রায় বিচ্ছিন্ন। আশপাশে কোন লোকালয় চোখে পড়লো না। হোটেলের সামনে জঙ্গলের ভেতর দু’ একটা ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট আছে ট্যুরিস্টদের জন্য। সাহেবরা অনেক সময়ই ফাইভ ষ্টার হোটেলে বসে খেতে পছন্দ করে না। তাই রুচি পাল্টাতে আসে এসব ঘুপচি ঘরে। সুইমিংপুলের পাশ ঘেঁষে চলে এলাম সী বীচে। সী বীচে তখনও অতি উৎসাহী সাহেব মেমরা স্নানে ব্যস্ত। সী বীচের চারপাশে তখন বীয়ার আর স্যাম্পেনের ফোয়ারা। হোটেলের ট্রপিক্যাল বীচ বার তখন পরিপূর্ণ। এ দৃশ্য দেখলে কে বলবে মালয়েশিয়া মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশ। আপনার মনে হবে এটি হাওয়াই দ্বীপের ওয়াইকিকি বীচ। সন্ধ্যা গড়ালো। অনি তাড়া দিচ্ছিল ডিনারের জন্য। কোথায় ডিনার খাবো তা নিয়ে বিভ্রান্তি। সুদি বললো চলো ট্যাক্সি ভাড়া করে শহরের ভেতর যাই। চন্দনা সায় দিলো না। এ হোটেল থেকে মূল শহরের দূরত্ব কতোটুকু, তা আমাদের ধাতে নেই। বিদেশ বিভূই। কাউকে এখানে জানি না – চিনিও না। তাই রাতে আর বেরুলাম না। ডিনার করবো এ হোটেলেই। কোথায় ডিনার সারবো। তাতেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব। লাগেন্ডা রেস্টুরেন্ট, মারিও ইতালিয়ান রেস্টুরেন্ট, সানসেট টেরেসে তখন মহাধূমধামে ডিনার চলছে। ইতালিয়ান খাবার আমাদের পছন্দ নয়। খোদ রোমে যেয়েও আমরা পিজা-পাস্তা খেতে চাইনি। অনির মহাপছন্দ পিজা। ও আমাদের জোর করেই ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টের দিকে নিয়ে যেতে চাইলো। আমরা সায় দিলাম না। বিদেশে গেলেই আমরা বাফেট ডিনার কিংবা লাঞ্চ খুঁজি। কারণ এতে খাবার সিলেকশনের স্বাধীনতা থাকে। হোটেলের একজন কর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম এই হোটেলে কিংবা আশপাশে বুফে ডিনারের ব্যবস্থা আছে কিনা? সে বললো মিড নাইট পর্যন্ত লাগেন্ডা রেস্টুরেন্টে বারবিকিউ ডিনার চলবে। বারবিকিউ ডিনার মানে আগুনে ঝলসানো মাংস কিংবা মাছের ডিনার। ঢুকে গেলাম লাগেন্ডাতে। খাসী, গরু, সামুদ্রিক মাছ কিংবা গলদা চিংড়ির বারবিকিউ। তবে ওটি পারফেক্ট বারবিকিউ ডিনার ছিল না। ঝলসানো খাবারের সাথে ছিল শতেক রকমের এশিয়ান, আমেরিকান কিংবা জাপানী খাবার দাবার। মাথাপিছু মাত্র বিশ ডলারে অমন ডিনার ইউরোপ আমেরিকাতে কেন সিঙ্গাপুরেও চিন্তা করা যায় না। বড় বড় গলদা চিংড়ি, কুককে বলা সাথে সাথে হয়ে যায় ফ্রাই। যতো খুশী খাও। কেউ বাধা দিবে না। যতো খুশী খাও আর যতোক্ষণ খুশী ততোক্ষণ খাও এদুটোই বুফে ডিনারের বাড়তি চার্ম। খেতে খেতে হঠাৎ করেই অনি বললো বাবা দ্যাখো, ঐ মেয়েটির ছবি এই হোটেলেও আছে। চেয়ে দেখি সত্যিই তাই। এই একই নারীর পোট্রেট আমরা এয়ারপোর্টে ও বিভিন্ন জায়গায় দেখে এসেছি। কিন্তু কোথাও এই নারীর পরিচয় লেখা নেই। এখানেও নেই। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়েই দেখলাম শুধু এক জায়গায় নয় বিভিন্ন জায়গায় এই রমণীর পোট্রেট শোভা পাচ্ছে। অনুসন্ধিৎসাটা আর চেপে রাখতে পারলাম না। রিসেপশনিষ্ট মেয়েটির কাছে এসে ঐ নারীর পোট্রেটটির দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইলাম তার পরিচয়। চাইনীজ মেয়েটি আমার প্রশ্নটি শুনে বোধহয় বেশ অবাকই হলো। এমনিতেই ফকফকা সুন্দরী মংগল মেমদের মুখ দেখতে অনেকটা পুতুলের মতো। আর এখন আমার প্রশ্ন শুনে ঐ মেমটির মুখ যেন পুরোপুরি বার্বিডল হয়ে গেল। চোখে কোন নড়ন-চড়ন নেই। একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকলো আমার মুখের দিকে। বুঝতে পারলাম তৈলচিত্রের ঐ নারী মূর্তিটি সম্পর্কে না জেনে এই দ্বীপে আসা আমার উচিত হয়নি। বাকিংহাম প্যালেসের সামনে দাঁড়িয়ে কোন পর্যটক যদি রাণীমাতার পোট্রেটের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে কোন বৃটিশ মেমের কাছে জানতে চায় ঐ ছবিটি কার তবে ঐ মেম সাহেবের মুখের আদল বিস্ময়ে যেমন বদলে যাবে ঠিক তেমনি অবস্থা তখন চাইনীজ মেয়েটির। সে সোজা সাপটা আমার প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। ড্রয়ার থেকে একটা বই বের করে তা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। শুধু আলতো করে বললো লাংকাউই দ্বীপ মানেই ঐ নারী। বাকীটা বই থেকে পড়ে নিতে। বইটা হাতে নিলাম। ডিসকভারি সিরিজের বই। প্রচ্ছদে লেখা লাংকাউই – আইল্যান্ড অব লিজেন্ড। অর্থাৎ অলৌকিক কাহিনীর দ্বীপ লাংকাউই। চন্দনা, সুদি আর অনির চোখে তখন অনেক ঘুম। গত দুদিনে টায়ারিং জার্নি করেছি আমরা চারজন। মেলবোর্ণ থেকে সিডনি, সিডনি থেকে কুয়ালালামপুর তারপর এক রাত না পেরুতেই লাংকাউই। ওরা চলে গেল ঘরে। আমার তখনও ঘুম বা ক্লান্তি আসেনি। নতুন কোন কিছু জানার থাকলে আমার চোখে কখনো ঘুম আসে না।
একা একা চলে গেলাম সী সাইড বারে। তখনো জোড়ায় জোড়ায় বিদেশীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের পাড়ে। সাগরের পাড় ঘেঁষে ওপেন স্টেইজ বানানো ডিনার ডান্সের জন্য। প্রতি শনিবার সারারাত এখানে কনসার্ট হয় আর তার সাথে ডিনার আর ডিসকো। হোটেলের পেছনে এক জায়গায় একটা সাইনবোর্ড দেখলাম। তাতে লেখা আছে খবঃ ঁং সধহলধ ুড়ঁ. মাঞ্জা কথাটা বাংলা না ইংরেজি তা বুঝতে পারলাম না। ছোটবেলায় যারা ঘুড়ি উড়িয়ে অভ্যস্ত তারা সবাই মাঞ্জা কথাটার সাথে পরিচিত। সুতাকে ধারালো করার জন্য বার্লি আর কাঁচের গুঁড়া দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর সূতাতে মাঞ্জা দেয়া হয়। বার কয় চোখ কচলে ভাল করে তাকিয়ে দেখি ঐ সাইনবোর্ডটির পাশেই গুপ্তঘরের মতো একটি দরজা। নীল আলোর দরজা, স্পষ্টতই বুঝা গেল এটা হোটেলের মাসাজ পার্লার। চীনা, মালয়ি, ইতালি ও বাহারি মেয়ের সমাবেশ আছে এখানে। লেখা আছে মাসাজ করার ফি আশি রিংগিত। কিন্তু আমি জানি আশি রিংগিতই শেষ কথা নয়। মাসাজ রুমে একবার কোন পর্যটককে ঢুকাতে পারলেই কম্ম ফতে। একেক কাজের জন্য একেক রকমের চার্জ। মালয়েশিয়ান মেয়েরা এ কাজে মহা পটু। কি করে সাহেবদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আহোরণ করতে হয় তা তারা জানে। শুধু জানে বললে ভুল হবে, খুব ভালো জানে। পেনাং শহরের মাসাজ পার্লারগুলো একবার ঘুরে দেখলেই বুঝা যাবে এরা সিঙ্গাপুর তো কোন ছাড়, কোন কোন ক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের পাটায়া পুখেতকেও হার মানিয়ে দিবে। মাসাজ পার্লারের কাণ্ড কাহিনী সবই আমি জানি। তবে মানুষকেও যে মাঞ্জা দেয়া যায় তা আজ রাতেই প্রথম জানলাম।
রাতে ব্যালকনিতে বসে আগামীকালের ভ্রমণসূচি নির্ধারণ করি। হলিডে ভিলার এই রিসোর্টের একটা বিশেষ দিক হলো সমুদ্রের দিকের প্রতিটি রুমের সাথে আছে লাগোয়া সুপরিসর ব্যালকনি। কোন ফাইভ ষ্টার হোটেলে সাধারণত এমন দেখা যায় না। একবার আমরা ছিলাম জাকার্তার শারি প্যানপ্যাসিফিক হোটেলে। ঐ হোটেলেও ছিল রুম লাগোয়া ব্যালকনি। রাতে যখন জাকার্তা ঘুমায় তখন ব্যালকনিতে বসে নিশি রাতের শহর দেখা যায়। সুউচ্চ হোটেলের ব্যালকনিতে বসে রাতের আঁধারে চা কফি খেলে পরিবেশকে অনেকটা ভুতুড়ে মনে হয়। মনে হয় যেন চিলেকোঠায় বসে আছি। তবে হলিডে ভিলাকে চিলেকোঠা ভাবার কোন উপায় নেই কারণ এই হোটেলটিই মাত্র দোতলা। রাত বাড়ে আর সমুদ্রের গর্জন বাড়ে। হোটেল সংলগ্ন সমুদ্রের সৈকতটি রাতেও আলোতে উজ্জ্বল। বোঝা যায় সিকিউরিটির কারণে এতো আলোক বিন্যাস। অতি উৎসাহী পর্যটকরাও এতোক্ষণে সৈকত ছেড়ে নিজ নিজ ঘরে চলে গেছে। তাই সমুদ্র পাড় এখন একেবারেই সুনশান। রাতে ঘরে শুয়েও অন্তর দিয়ে অনুভব করতে থাকি সমুদ্রের হাসি কান্না মেশানো গর্জন। সমুদ্র স্রোতের আওয়াজ এতো কাছে অনুমান হয় যে মাঝে মাঝে মনে হয় এই বুঝি সাগরের নোনাজল উপচে পড়বে আমাদের ঘরে। পুখেতের বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত পাতং বীচে আমরা একবার চার পাঁচ দিন কাটিয়ে এসেছি আন্দামান সী ভিউ হোটেলে। সেখানেও ঘরের পাশেই ছিল সমুদ্র। এখানেও তাই। আজো আমার মনে আছে পুখেত থেকে ঢাকা ফিরে আসার দু সপ্তাহের মধ্যে পৃথিবীর ভয়াবহ সুনামীতে পুখেত লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। পাতং বীচের পাড়ে গড়ে ওঠা প্রায় দু ডজন ডিলাক্স হোটেল সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এদের মধ্যে একটি ছিল আন্দামান সী ভিউ হোটেল। আজ রাতে আমরা যেমন লাংকাউই সাগরের পাড়ে বিছানায় শুয়ে আছি নিশ্চয়ই ঐদিন রাতে আন্দামান সী ভিউতেও কারুর পরিবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিল ঐ ঘরটিতে। কে জানতো ঐদিন রাতের আঁধারে তাদের সবার দেহ মহাকালের জন্য মিশে যাবে সমুদ্রের নোনাজলে। সাগর পাড়ে পর্যটন করার ভয়াবহতা মনে করতে করতেই এক সময় ঘুম আসে দু চোখ জুড়ে।
সকালে লাগেন্ডা রেষ্টুরেন্টে বাফেট ব্রেকফাষ্ট। বলা যায় রাজকীয় নাস্তা। এক নাস্তাতেই শত পদের খাবার। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়ার যেকোন শহরে যারা প্যাকেজ ট্যুরে ভ্রমণ করে অভ্যস্ত তারা সবাই জানে এসব হোটেলের সকালের খাবার কতোটা জাঁকালো। সকাল দশটার দিকে ব্রেকফাষ্ট করলে দুপুরের লাঞ্চটা বেমালুম চেপে যাওয়া যায়। আর কেউ যদি সত্যি সত্যি ভোজন রসিক হয় তবে পেট চুক্তি ব্রেকফাষ্ট খেয়ে লাঞ্চ-ডিনার স্কিপ করে একেবারে আগামীকাল ব্রেকফাষ্ট টেবিলেও আসতে পারেন। আমার স্ত্রী-কন্যার আবার বুফে ব্রেকফাষ্টে কমপক্ষে এক ঘন্টা কাটানোর অভ্যাস। আজো তাই হলো, সকাল আটটা থেকে ন’টা পর্যন্ত কাটলো লাগেন্ডা রেষ্টুরেন্টে। সকাল ন’টায় বের হয়ে এসেই দেখি মে ফ্লাওয়ার ট্র্যাভেল এজেন্সির মংক্রোবাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। মালয়েশিয়ান এয়ার লাইনের সাথে আমাদের ট্যুরের চুক্তিতেই এই ট্যুর অন্তর্ভুক্ত। শুধু আমরা না, আরো একটি সাহেব-মেমদের ফ্যামিলি আমাদের সাথে যোগ হলো। তারা এসেছে ইতালী থেকে লাংকাউই দেখতে। আমাদের ড্রাইভার ইংরেজিতে ফ্লুয়েন্ট। সাধারণত প্রতিটি ট্যুরিস্ট স্পটেই দেখেছি ড্রাইভাররা ইংরেজি বুঝতে ও বলতে পারে। শুধু এর ব্যত্যয় দেখা যায় থাইল্যান্ডে। থাইরা কখনো ভাল ইংরেজি বুঝে না। এমনকি ষ্টার রেটেড হোটেলেও এ অবস্থা। ড্রাইভার প্রথমেই জানতে চাইলো আমরা প্রথমে কোথায় যেতে ইচ্ছুক। আমার কোন কিছু বলতে হলো না। ইতালীয় মেমটি আমাদের দিকে ভ্রƒক্ষেপ না করেই বলে দিল তারা সর্বপ্রথমে কুটা মাশুরি দেখতে আগ্রহী। আমাদেরও তাই ইচ্ছা। দুই ফ্যামিলির ইচ্ছা হুবহু এক। তাই গাড়ী চললো কুটা মাশুরির দিকে। এই প্রথম দিনের আলোতে লাংকাউই দ্বীপকে ভালভাবে দেখতে চেষ্টা করলাম।
মোট তেরটি রাজ্য নিয়ে মালয়েশিয়া। এর মধ্যে এগারোটি মালয়ি পেনিনশ্যুলাতে আর বাকী দুটি বোরনিও দ্বীপে। বোরনিও পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ। লাংকাউই মালয়েশিয়ার কেডা রাজ্যে অবস্থিত, যা একেবারেই সমুদ্রের ভেতরে। বাসে ট্রেনে করে এই দ্বীপে আসা যাবে না। আসতে হবে আকাশে উড়ে আর নাহলে জলে ভেসে। কেডা রাজ্যকে বলা হয় জরপব নড়ষি ড়ভ গধষধুংরধ. খাদ্য শস্য উৎপন্ন করতে এই দ্বীপ মালয়েশিয়ায় এক নম্বরে। ছোট ছোট ৯৯টি আরকিপিল্যাগো বা দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে লাংকাউই। আন্দামান সাগরের পাড়ে থাইল্যান্ডের পাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর একটি স্বপ্নিল পর্যটন কেন্দ্র। সমগ্র দ্বীপটির আয়তন ৫২৮ বর্গ কিলোমিটার। লাংকাউই দ্বীপের জনসংখ্যা ষাট হাজার। এ দ্বীপের রাজধানীর নাম কূয়া। সমগ্র লাংকাউই একটি ডিউটি ফ্রি দ্বীপ। খধহমশধরি কথাটা এসেছে দুটি শব্দ সংযুক্ত হয়ে। খধহম কথার অর্থ হলো হেলাং। এটি একটি মালয়ি শব্দ যা ঈগল পাখীকে বোঝায়। আর কধরি একটি সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ মার্বেল। এক সময় এই দ্বীপ ছিল ঈগল পাখীদের অভয়ারণ্য। আর এখানে পাওয়া যায় বিবিধ ধরনের মার্বেল। তাই ঈগল আর মার্বেল দুটি কথার সংযুক্তি ঘটিয়ে এ দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছে খধহমশধরি। আমাদের মাইক্রোবাসটি চলছে সাগরের পাড় ঘেঁষে আর পাহাড় ডিঙ্গিয়ে। পাহাড় আর সাগরের মহামিলন এই দ্বীপে। বিস্তীর্ণ এলাকা কিন্তু কোথাও কোন জনবসতি দেখা যায় না। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া মানুষের সংখ্যা নাই বললেই চলে। রাস্তায় বের হয়েই আমার মনে হলো এই দ্বীপের মানুষগুলো গেল কোথায়? চারপাশ এতো ভূতুড়ে আর জনমুনিষ্যি শূন্য কেন? হঠাৎ করেই আমার ছেলে সুদি বললো বাবা ঐ দ্যাখ শহর। ডান দিকে তাকাতেই দেখি সত্যিই তাই। হঠাৎ করেই যেন নির্জন সাগরে ভেসে ওঠা আইসবার্গের মতো একটা ছোট্ট শহর দৃশ্যমান হলো। গাড়ী চলছে শহরের দিকে। গাড়ীতে উঠেই একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম আমরা। কুটা মাশুরি যে লাংকাউই’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান তা রাস্তায় বেরুলেই বুঝা যায়। কয়েকশ গজ পর পরই ছোট ছোট সাইনবোর্ডে তীর চিহ্ন দিয়ে দেখিয়ে দেয়া আছে মাশুরির মিউজিয়াম কোন্ দিকে। লাংকাউইতে পর্যটনের স্থান অগুনতি কিন্তু তাদের মধ্যে কুটা মাশুরি অনন্য। ঠিক এমন অবস্থা দেখেছি ল্যুভর মিউজিয়ামে। প্যারিসের এই মিউজিয়ামে তিশিয়ান, রেমব্রান্ট, পোশিয়ান, রাফায়েল, বাউচার, ক্যারভ্যাগিনো কিংবা মাইকেলাঞ্জেলোসহ অনেক জগৎ বিখ্যাত শিল্পীদের ছবি শিল্পকর্ম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু পর্যটকদের তো সব শিল্পকর্মের প্রতি তেমন কোন আকর্ষণ নেই। সবাই যেতে চায় মোনালিসার কাছে। তাই ল্যুভর কর্তৃপক্ষ এই বিশাল মিউজিয়ামের গেট থেকে মূল গ্যালারি পর্যন্ত ছোট ছোট সাইনবোর্ডে অ্যারো চিহ্ন এঁকে বুঝিয়ে দিয়েছে লিওনার্দো ভিঞ্চির মোনালিসা কোন্ দিকে। ল্যুভরে দেখেছি মানুষের ঢল মোনালিসার গ্যালারির দিকে। ঠিক একই অবস্থা লাংকাউইতে। এই দ্বীপের সব প্রধান প্রধান জায়গায় লেখা আছে কুটা মাশুরি কোন পথে যেতে হবে। এর কিছুক্ষণ পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম কূয়া শহরে। ছোটখাটো একটা ছিমছাম শহর। তবে আভিজাত্যে সিঙ্গাপুর কিংবা ব্যাংককের সাথে তুলনীয়। এমন একটি নির্জন দ্বীপে হঠাৎ করে একটা আধুনিক শহর পাওয়া যাবে তা ভেবে অবাক হতে হয়। আমাদেরকে নামিয়ে দেয়া হলো শহরে। বলা হলো এক ঘন্টা সময় দেয়া হলো শহর দেখার জন্য। তারপর গাড়ী ছাড়বে মাশুরির মিউজিয়ামের দিকে। কূয়া শহর থেকে কুটা মাশুরির দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। এক ঘন্টা অনেক সময়। পায়ে হেঁটে চললাম, শহর পরিভ্রমণে। এই শহরটির নাম কূয়া কেন তার পেছনে একটা ছোটখাটো ইতিহাস আছে। মালয়ি ভাষায় কূয়া কথার ইংরেজি অর্থ হলো এৎধাু অর্থাৎ রস কিংবা মাংসের ঝোল। কথিত আছে এক সময় এই দ্বীপের রাজার সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করার জন্য দুই বিশালদেহী পুরুষের মধ্যে মল্ল যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় এই স্থানটিতে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে বিশাল ভান্ডে রাখা মাংসের ঝোলের পাত্রটি ভেঙ্গে যায়। সুরা বা ঝোল সবটুকু ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে। এই ঝোল থেকেই এই জায়গাটির নাম হয়ে যায় কূয়া অর্থাৎ ঝোল। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে অন্য দশটা শহর থেকে কূয়াকে পার্থক্য করা যায় না। একটা গতানুগতিক আধুনিক শহরে যা যা থাকা দরকার, তার সব কিছুই আছে কূয়া শহরে। কিন্তু এরই মধ্যে চেয়ে দেখি চন্দনা, সুদি আর অনি আমার চারপাশে নেই। ওরা হারিয়ে গেছে সে কথা আমি বিলক্ষণ চিন্তাও করলাম না। আশপাশে চেয়ে দেখার চেষ্টা করি কোথাও কোন বড় মার্কেট কিংবা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে কিনা। ক’কদম এগুতেই চোখে পড়লো বিরাট মার্কেট। সামনে সাইনবোর্ড। তাতে লেখা বিলিয়ন সুপার মল। আমি নিশ্চিত বুঝতে পারলাম ওরা এখানেই আছে। একটু এগুতেই অনির কথার আওয়াজ পেলাম। ও আমাকে ডেকে বলছে- বাবা আমরা এখানে। মার্কেটের নাম বিলিয়ান মার্কেট। এই মার্কেটটা কি সাধারণ মানুষের জন্য না শুধু বিলিয়নারীদের জন্য তা বোধগম্য হলো না। কিছুক্ষণ পর চন্দনা মার্কেট থেকে বেরিয়ে আমাকে বললো এই মার্কেটে জিনিসপত্রের দাম অনেক কম তাই সে সন্ধ্যায় এখানে আসতে চায়। আমাদের প্যাকেজ ট্যুর বিকেল চারটা পর্যন্ত। তাই ট্যাক্সি ভাড়া করে সন্ধ্যায় এখানে আসা খুবই সহজ। রাজী হলাম আবার সন্ধ্যায় কূয়া শহরে আসতে। সাড়ে দশটার দিকে রওয়ানা হলাম কুটা মাশুরির দিকে।
কড়ঃধ গধযংঁৎর কথা যার অর্থ হলো মাশুরির শহর। কড়ঃধ কথার অর্থ হলো ঞড়হি। মাশুরি নামের এক নারীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই শহর। লাংকাউই দ্বীপের উলু মেলাকা এলাকায় গড়ে উঠেছে কুটা মাশুরি কালচারাল সেন্টার। একে অনেকে মিউজিয়ামও বলে। মিউজিয়ামের গেটে আমাদের গাড়ী থামলো। নেমেই দেখি শত শত পর্যটক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভেতরে ঢোকার টিকিট কেনার জন্য। জনপ্রতি এন্ট্রি ফি দশ রিংগিত। আমাদের সাথে যারা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে তারা সবাই বিদেশী। এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ডজন ডজন এয়ারকন বাস আর মাইক্রোবাস। সবাই এখানে বিদেশী।
কুটা মাশুরিতে ঢুকেই প্রথম চোখে পড়লো একটি সমাধি। বুঝতে পারলাম এটি মাশুরির সমাধি। মাশুরির পুরো নাম মাশুরি বিনতে পানডাক মায়া। তখনও আমি বুঝতে পারছিলাম না এই নারী এই দ্বীপে কেন এতো বিখ্যাত। কেন সবাই আসে এই নারীর সমাধিতে? এর উত্তর পেতে দেরী হলো না। না জেনে শুনে এখানে সেখানে ঘোরাফেরা করার চাইতে জেনে শুনে দেখা ভাল। তাই ঢুকে গেলাম মাশুরির মিউজিয়ামে। কারণ হোটেলের বুকলেটে মাশুরির ছবি আছে অনেক কিন্তু ইতিহাস আছে অতি সামান্য। মিউজিয়ামের গেটে প্রতিদিন সকাল ন’টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত মালয়ি কিশোর-কিশোরীরা নাচ গান করে। মিউজিয়ামে ঢুকেই বুঝতে পারলাম মাশুরি নামের এই নারী কেন লাংকাউইতে অদ্বিতীয়।
মাশুরি মিউজিয়ামটি মাশুরির ব্যক্তিগত কথকথা আর পারিবারিক জীবন নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। মূল গ্যালারিটির প্রতিটি জায়গায় স্থান পেয়েছে ঐ অনিন্দ সুন্দরী নারীর পোর্টেট। ১৮১৫ সালের দিকে মাশুরি বিনতে পানডাক মায়া নামের এক যুবতীর রূপের কথা এই দ্বীপে সর্বত্র আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব আসতে থাকে চারদিক থেকে। সে সময় লাংকাউই এর গোষ্ঠী প্রধান ছিল দাতু পাকেরান জায়া। তার ছোট ভাই ওয়ান ডারুসের সাথে মাশুরির বিয়ে ঠিক হয়। মাশুরির বিয়েতে তার বাবা পানডাক মায়া এবং মা কিট অ্যালাং যারপরনাই খুশী হয়। সামান্য কৃষকের মেয়ে হয়ে যায় রাজবধূ। কিন্তু মাশুরির জীবন সুখের হয়নি। স্বামী তাকে ভালবাসলেও সে রাজ পরিবারের অন্যদের কাছ থেকে এতোটুকু ভালবাসা পায়নি। সবচেয়ে আশ্চর্য হলো রাজার ছোট ভাই এর সাথে বিয়েতে প্রাথমিকভাবে মাশুরি নিজে রাজীই হতে চায়নি। মাশুরি চেয়েছিল সাধারণ যুবকের বৌ হয়ে ছিমছাম সাধারণ জীবন বেছে নিতে। কিন্তু দ্বীপের সবচেয়ে সুন্দরী নারীর বিয়ে হবে অন্য পুরুষের সাথে তা লাংকাউই-এর গোষ্ঠী প্রধানরা মেনে নেয়নি। প্রায় জোর করেই মাশুরিকে ওয়ান ডারুসের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয়। স্বামী ভাগ্য মাশুরির ভালো ছিল। কিন্তু ওয়ান ডারুসের বড় ভাই রাজা পাকেরান জায়ার স্ত্রী মোহরা একেবারেই মাশুরিকে সহ্য করতে পারছিল না। মোহরা নানাভাবে তার বান্ধবীদের দিয়ে মাশুরিকে হেনস্তা করতে থাকে। এক সময় মোহরা মাশুরির রূপে আর গুণে অসহ্য হয়ে তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে। ১৮১৯ সালের প্রথম দিকে মাশুরির স্বামী বিদেশে যায় কয়েক সপ্তাহের জন্য। আর ঐ সুযোগেই মোহরা তার পরিকল্পনাটি চরিতার্থ করে। একদিন বিকেলে মাশুরির এক দু:সম্পর্কের আত্মীয় যুবক বাটু বাহারা থেকে মাশুরির সাথে দেখা করতে আসে। যুবকটির নাম ছিল ডেরামবাং। বিকেলে মাশুরি আর ডেরামবাং বসে আলাপ করছিল। তারপর দিন মোহরা চারদিকে রটিয়ে দেয় মাশুরি চরিত্রহীন। সে ঐ ভিনদেশী যুবকের সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। মোহরা তার তিন বান্ধবীকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করলো। তারা বললো মাশুরিকে নাকি তারা ঘরের ভেতর সহবাসরত দেখেছে। মাশুরির জীবনে নেমে এলো ঘোর অমানিশা। স্বামী রাজ্যে নেই কিন্তু বিচার হয়ে গেল একতরফা। স্ত্রীর প্ররোচনায় রাজা পাকেরান জায়া তড়িঘড়ি করে মাশুরির বিচার করে ফেলে। বিচারে মাশুরির প্রাণদণ্ড হয়। একই সাথে কথিত প্রেমিক ডেরামবাং-এরও প্রাণদণ্ড হয়। প্রতারণা আর বিশ্বাসঘাতকতার জন্য নিষ্পাপ মাশুরি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। রাজা ছোট ভাই ওয়ান ডারুসের জন্য অপেক্ষা করলো না। তাড়াতাড়ি ভাই ফিরে আসার আগেই মাশুরির প্রাণ সংহার করতে সে সব আয়োজন পূর্ণ করে। মৃত্যুদণ্ডের দিন একটি গাছের সাথে মাশুরিকে বেঁধে ফেলা হয়। তারপর প্রকাশ্য দিবালোকে কীরিচ দিয়ে মাশুরির শরীরে আঘাত করা হয়। রাজ জল্লাদ আরিয়া বার বার বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে মাশুরিকে আঘাত করতে থাকে কিন্তু কোন অস্ত্রই মাশুরির শরীরে বিঁধছিল না। রাজ্যের সব ভয়ংকর অস্ত্র দিয়ে পর পর পাঁচ দিন চেষ্টা করেও মাশুরির প্রাণদণ্ড কার্যকর করতে ব্যর্থ হয় রাজা। রাজা আর মোহরা লজ্জায় ডুবে যায়। চারদিকে যখন প্রচণ্ড রোদ তখন মাশুরিকে যে স্থানে বেঁধে রাখা হয়েছে তার ওপরে পাখিরা তাদের পাখা দিয়ে সামিয়ানা তৈরি করে রাখতো যাতে মাশুরির শরীরে একটুও রোদের আঁচ না লাগে। এতোসব অলৌকিক কাণ্ড-কারখানা দেখে রাজ্যের অধিবাসীদের মনে ধারণা জন্মে যে, মাশুরি হয়তো কোন ষড়যন্ত্রের শিকার। তখন রাজ্যের সব কৃষকরা তাদের যাবতীয় সোনাদানা আর শস্য রাজাকে দিয়ে পরিবর্তে মাশুরির প্রাণ ভিক্ষা করে। রাজা সামান্য নরম হলেও তার স্ত্রী মোহরাকে পেয়ে বসে খুনের নেশায়। যে করেই হোক মাশুরিকে হত্যা করতেই হবে। সে তখন জল্লাদ আরিয়াকে মাশুরির কাছে পাঠায় কেন তাকে হত্যা করা যাচ্ছে না রহস্য জানতে। লজ্জায় মাশুরি আর এ জীবন রাখতে চায়নি। সে তখন আরিয়াকে বলে তাদের পারিবারিক কীরিচ দিয়ে আঘাত করলেই তার মৃত্যু ঘটবে। এর পরদিন মাশুরির পারিবারিক কীরিচ দিয়ে মাশুরিকে আঘাত করা হলো। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে মাশুরি লাংকাউই দ্বীপকে অভিশাপ দিয়ে যায়। সে বার বার উচ্চারণ করতে থাকে সে যদি নিষ্পাপ হয় তবে সাত জনম এই দ্বীপে কোন শস্য দানা মাটিতে ফলবে না। এই দ্বীপ হয়ে যাবে বিরাণ ভূমি। কথিত আছে মাশুরির বুকে আঘাত করার পর তার বুক থেকে লাল রক্তের পরিবর্তে সাদা রক্ত গল গল করে বেরুতে থাকে। আর ঐ সাদা রক্ত মাটিতে না পড়ে আকাশের দিকে ধাবিত হয়ে মেঘের সাথে মিশে যায়। মাশুরির মৃত্যু হওয়ার সাথে সাথে বনে বনে আগুন লেগে যায়। পাকা শস্য ক্ষেতের ফসল জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। মাত্র এক বছরের মধ্যে লাংকাউই মরুভূমির মতো নিষ্ফলা হয়ে ওঠে। মাশুরির অভিশাপে এই দ্বীপ হয়ে ওঠে অভিশপ্ত রাজ্য। ক্ষুধার তাড়ণায় এ দ্বীপের মানুষ মূলত থাইল্যান্ডের দিকে চলে যায়। রাজ্য ফেলে রাজারা হয় দেশান্তরী। মাশুরির বাবা-মা মেয়ে হারানোর লজ্জায় আর ক্ষোভে থাইল্যান্ডের পুখেতে আশ্রয় নেয়। একমাত্র পুত্র ওয়ান হাকিমকে নিয়ে মাশুরির স্বামী ওয়ান ডারুস থাইল্যান্ডে নির্বাসিত জীবন যাপন করে। মাশুরির অভিশাপের সাত জনম পার হয় হয় ১৯৮০ সালে। লাংকাউই এর মানুষরা আশায় ছিল কখন মাশুরি পরিবারে সাত জেনারেশন পার হয়। কারণ শুধু তাহলেই মাশুরির অভিশাপের মেয়াদ পার হবে। দুর্ভিক্ষ আর ক্ষুধার রাজ্য আনন্দে নেচে ওঠে ১৯৮০ সালে। ঐ বছর ওয়ান ডারুস আর মাশুরির পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এক নবজাতক নারী, যার নাম আসিয়া নোয়াই। জন্মের পর পরই মালয়েশিয়ানরা আসিয়াকে থাইল্যান্ড থেকে লাংকাউই নিয়ে আসে। কথিত আছে আসিয়া লাংকাউই এর মাটিতে পা রাখার সাথে সাথে রাতারাতি বদলে যায় এই দ্বীপের আদল। মাত্র পঁচিশ বছরে এই দ্বীপ আজ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। উৎকৃষ্ট মানের ধান উৎপন্ন করার জন্য লাংকাউই আজ মালয়েশিয়ার গর্ব। পরিমাণে বেশি নয় কিন্তু মানে এখানকার ধান চমৎকার। মাশুরিকে লাংকাউই-এর অধিবাসীরা দেবতা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করে। তাকে বলা হয় সততা আর পবিত্রতার প্রতীক। প্রায় এক ঘন্টা আমরা মিউজিয়ামে এদিক সেদিক ঘুরে দেখলাম। শত বছরের পুরনো ফটো আর পোর্ট্রেট ভরা গ্যালারি। আর তার সাথে আছে অডিও আর ভিডিও বর্ণিত ইতিহাস। মাশুরি আর তার পরিবারের বংশানুক্রম সাজানো আছে পোস্টারে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য হলো এই মিউজিয়ামে মাশুরির ওপর লেখা ইংরেজিতে কোন বই নেই। ইচ্ছে ছিল ক্যামেরা দিয়ে পোস্টারগুলোর ছবি করে নেয়া। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। মিউজিয়ামের ভেতর ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশে কড়াকড়ি। ক্যামেরায় ক্লিক করলেই হুজ্জতি। তাই অগত্যা ডায়রিতে যতোটা পারলাম লিখে নিলাম। আমার মেয়ে এসব বিষয়ে পারঙ্গম। আমি একটা আর অনি অন্যটা এভাবে মাশুরি সম্বন্ধীয় বেশকিছু ইতিহাস আমরা দুজন টুকে নিলাম। মিউজিয়ামের এক জায়গায় লেখা আছে এই সমাধিস্থলে মাশুরিকে হত্যা করা হয়নি। মাশুরির প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয় তামান কীরিচ নামক স্থানে। মাশুরির সমাধিস্থল থেকে তামান কীরিচের দূরত্ব পঁচিশ কিলোমিটারের মতো, জায়গাটা এয়ারপোর্ট সংলগ্ন। সেখানেও মাশুরির একটি স্মৃতিসৌধ আছে। ইতিহাস পড়ে জানলাম যে কীরিচটি দিয়ে মাশুরিকে হত্যা করা হয় সেটি রক্ষিত আছে তামান কীরিচ এলাকায়। এবং এই কীরিচের নামানুসারেই জায়গাটির নাম হয়ে গেছে তামান কীরিচ। এবার মিউজিয়াম দেখে বের হলাম মাশুরির স্মৃতি বিজড়িত জায়গাটি ঘুরেফিরে দেখতে। মাশুরি স্মৃতিসৌধের কাছে দাঁড়িয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হলো। যখন প্রথম এই সমাধির কাছে এসেছিলাম তখন আমার এমন অনুভূতি ছিল না। ভেবেছিলাম কোন রাজকন্যার সমাধিক্ষেত্র এটি। কিন্তু এটি যে এক নির্যাতিতা রাজবধূর সমাধি তা এইমাত্র জানলাম। চারপার্শ্বে অনেক বিদেশী। সবারই আকর্ষণ মাশুরির সমাধি। একপাশে তৈরি করা আছে স্থায়ী মঞ্চ। সেই মঞ্চে কোন কোন বিশেষ দিনে মাশুরির জীবন নিয়ে থিয়েটার হয়। একজন মালয়েশিয়ান নায়িকা আছে যার মুখের আদল অনেকটা মাশুরি বিনতে পানডাকের মতো। সাধারণত ঐ নায়িকাকে দিয়েই মাশুরির রোল করানো হয়। এই নারীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে কুটা মাশুরি বা মাশুরির টাউন নামে একটি ছোট্ট শহর। প্রতিবছর গড়ে কুড়ি লক্ষ পর্যটক এই সমাধিস্থলে আসে। ধারণা করা হয় মাশুরির পরিবার এই এলাকাতেই বাস করতো। মাশুরির মৃত্যুর পর রাজ পরিবারটি সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। রাজবাড়ীর অবশিষ্ট আর কিছু এখানে নেই। শুধু আছে মাশুরির ঘরের রিপ্লিকা। সমাধিস্থল থেকে মাত্র একশ গজ দূরে আছে টেলেগা মাশুরি। অর্থাৎ মাশুরির কুয়া। কথিত আছে ঐ কুপের জল মাশুরি নিজে ব্যবহার করতো। এই কুয়ার জল হোলি ওয়াটার হিসেবে বিবেচিত। তাই এক বোতল জল কিনতে দিতে হয় দশ রিংগিত। এসব কাণ্ড-কারখানা দেখে আমি ভাবি কি করে পর্যটকদের পকেট খালি করতে হয় সে বিদ্যায় মালয়িরা সিঙ্গাপুরিয়ান কিংবা থাইদেরও ছাড়িয়ে গেছে। এই এলাকার লোক আর্ট কালচারে বেশ উন্নত। পোর্ট্রেট আঁকিয়েরা সারি সারি বসে আছে। পঁচিশ রিংগিত দিলে আধ ঘন্টার মধ্যে তৈরি করে দিবে পেন্সিল স্কেচের পোর্ট্রেট। প্রতিদিন সকাল নটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত চলে এসব বিচিত্র কাজ কারবার।
দুপুর তখন দেড়টা। এবার যাচ্ছি সমুদ্র সৈকতে। কিন্তু আমার মাথা থেকে তামান কীরিচের ব্যাপারটা যাচ্ছে না। সী বীচ তো জীবনে অনেক দেখেছি। কিন্তু এমন ইতিহাস তো কোনদিন শুনিনি। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের ফেরার রাস্তায় তামান কীরিচ পড়বে কিনা। কিন্তু সে হতাশ হওয়ার মতো উত্তর দিল। সে বললো তামান কীরিচ কুটা মাশুরি শহরের ঠিক উল্টো পাশে। যেতে হলে অন্য দিন যেতে হবে। গাড়ীতে উঠার আগে মাশুরির সমাধি সম্পর্কিত আর একটি তথ্য জেনে নিলাম। ১৯৪০ সালের আগে মাশুরির কবরটি বাঁধানো ছিল না। ঐ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টেংকু আব্দুর রহমান পুত্রা আলহাজ্ আনুষ্ঠানিকভাবে মাশুরির সমাধি স্থল স্থাপনার উদ্বোধন করেন। মালয়েশিয়ানরা মাশুরি লিজেন্ডটি পুরোপুরি বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে ১৯৮০ সালে অভিশাপমুক্তির পর থেকে রাতারাতি লাংকাউই বিখ্যাত হয়ে গেছে। ছোট্ট একটা দ্বীপ যেখানে বাস কিংবা ট্রেনে যাওয়া যায় না, সাগর থেকে চাইলে মনে হয় সাগরের মধ্যে ভেসে আছে এক খন্ড সবুজ ভূমি। আর সেই ছোট্ট দ্বীপ শহর লাংকাউইতে আছে ৭৫টি স্টার রেটেড হোটেল। চিন্তা করা যায় কতোটা আকর্ষণীয় এই শহরটি।
এবারের গন্তব্য সী বীচ। সমুদ্র সৈকত সব পর্যটকদের জন্যই আকর্ষণীয়। কিন্তু ক’ বছর আগেই আমরা ভারতের গোয়া আর আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপের সী বীচগুলো দেখে এসেছি। যারা গোয়া বীচ কিংবা ওয়াইকিকি সী বীচ দেখে এসেছে তাদের কাছে পৃথিবীর অন্য কোন সৈকত তেমন ভাল লাগার কথা নয়। তবুও গাইডরা বললো লাংকাউই এর সমুদ্র সৈকতগুলো নাকি অন্য ধরনের। এ দ্বীপের একেকটি সৈকতের বৈশিষ্ট্য নাকি আলাদা ধরনের। লাংকাউইতে দেখার আছে অনেক কিছু। জলপ্রপাত, বিখ্যাত সেভেন ওয়েল, বুটিক ভিলেজ, ওরিয়েন্টাল ভিলেজ, লাংকাউই ক্যাবেল কার, আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড, কুমীরের ফার্ম, রাজকীয় প্রমোদতরীতে নৌবিহার- সব আছে এই ক্ষুদ্র দ্বীপটিতে। কিন্তু এখানে পর্যটকরা আসে মূলত এখানকার পৌরাণিক কাহিনীগুলোর স্পর্শ পেতে। তাই লাংকাউইকে বলা হয় ওংষধহফ ড়ভ ষবমবহফং . অলৌকিক কাহিনীর দ্বীপ। এ দ্বীপের প্রহেলিকাময় অতীত পর্যটকদের কাছে টানে। কুটা মাশুরির উত্তরে আরেক লৌকিক কাহিনীর স্থান গড়ে উঠেছে। এর নাম লেক অব প্র্যাগনেন্ট মেইডান অর্থাৎ কুমারী মাতার বিল। কথিত আছে শত শত বছর আগে এক পরীর পছন্দ হয়েছিল পার্থিব পুরুষকে। কুমারী পরীর গর্ভে জন্ম নেয় আধা হুর আর আধা মানুষ এক সন্তান। কিন্তু জন্মের কিছুক্ষণ পরই শিশুটি মারা যায়। পরী দেশের রাজকন্যা ব্যথিত হয়ে মৃত সন্তানকে এই বিলের জলে ভাসিয়ে দেয়। মর্ত ত্যাগ করার আগে ঐ রাজকন্যা পরী বলে যায় যে, বন্ধ্যা নারীরা এই লেকের জলে স্নান করলে তারা গর্ভধারণ করতে সক্ষম হবে। আজো এই রীতি লাংকাউই তে চলে আসছে। প্রতিদিন ডজন ডজন বন্ধ্যা নারী এখানে স্নান করতে আসে সন্তান কামনায়। এ সব দেখে আধা ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম প্রথম সমুদ্র সৈকতে। একেবারেই গ্রামের ভেতর দিয়ে ঢুকে গেলাম সৈকতে। যে রাস্তায় এলাম তার চারপাশে রাবার ট্রি ফার্ম। রাবার শিল্প লাংকাউই-এর প্রধান ব্যবসা। দ্বীপ জুড়েই মানুষের সংখ্যা বড়ো কম। পায়ে হেঁটে চলা মানুষ রাস্তায় খুবই কম। ড্রাইভার কাম গাইড আমাকে বললো এখানকার সব বাড়িতেই অন্তত: একটি মোটর সাইকেল আছে। কোন কোন পরিবারে চার পাঁচটি মোটর বাইকও আছে। বাচ্চারা স্কুলে যায় বাই সাইকেলে। নিরাপদ রাস্তা-ঘাট। গাড়ী ঘোড়ার সংখ্যা নিতান্তই কম। দ্বীপময় ঘুরে বেড়ায় শুধু পর্যটকদের বহর। সৈকতের পাশেই ছোট্ট বাজার। বলা যায় একটা শুঁটকি মাছের বাজার। এতো বড় শুঁটকি মাছের আড়ত কিন্তু তেমন কোন উৎকট গন্ধ নেই। আস্ত সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি থেকে শুরু করে কাচকি মাছের শুঁটকি সব পাওয়া যায়। লাংকাউই এর শুঁটকি ব্যবসা জমজমাট। রাস্তাঘাটে শুঁটকির ভ্যান গাড়ী ঘুরে বেড়ায়। দাম কম বলে আমার বৌ চন্দনা এক সাথে কম করে হলেও আট দশ কেজি কাচকি মাছের শুটকি কিনে ফেললো। দাম এতো আকর্ষণীয় যে, শুধু আমার বৌ কেন যে কোনদিন শুঁটকি খায়নি সেও যদি এমন কম দামে এতো ভাল শুঁটকি পায় তবে তারও কিনে নিয়ে কাউকে গিফট দিতে ইচ্ছে করবে। চলে এলাম সৈকতে। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকি সৈকতের রং-এর দিকে। পুরো সৈকতটি কালো রং-এর। বালির রং কালো। পাথরও কালো। তাই সৈকতের নাম ব্ল্যাক স্যান্ড বীচ। মালয়ি ভাষায় এই বীচকে বলা হয় পাসির হিটাম বীচ। কেন এই বীচের রং কালো তা নিয়েও লিজেন্ড আছে। এখানে লেখা আছে বহুকাল আগে জলদেবীর কাছে এখানকার জেলেরা একটা ওয়াদা করেছিল। কিন্তু বার বার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও তারা ঐ ওয়াদা পূরণ করেনি। তাই ক্ষুব্ধ জলদেবীর অভিশাপে জেলেদের সব ঘরবাড়ী পুড়ে যায় এবং সৈকতের বালিতে লেগে যায় আগুন। তাই আজও এই সৈকতের রং কালো। তবে ভূ-তাত্ত্বিকরা বলেন এই সৈকতের বালিতে টারমুলিন, ইলমেনাইট ও জিরকনের পরিমাণ বেশি। এই তিনটি যৌগ একত্র হওয়ার জন্য এখানকার সৈকতের রং কালো। এরপর আরো তিনটি সৈকত দেখে আবার হোটেল পানে যাত্রা। আজকের মতো এখানেই শেষ।
হোটেলে ফিরলাম বিকেল সাড়ে তিনটায়। আমাদের হোটেলের উল্টো দিকের ওয়ারং রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ সারলাম। দুপুরে ঘুমালেই সময় অপচয়। বিদেশে এলে কম সময়ে যতো বেশি দেখা যায় ততই ভাল। চন্দনা সকালে কূয়া শহরে দেখে এসেছে আকর্ষণীয় বিলিয়ন মার্কেট। সে সেখানে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব। তাকে উস্কে দিচ্ছে সুদি আর অনি। এখানে ট্যাক্সি পাওয়া দুষ্কর। হোটেল লবিতে বলা মাত্র কোত্থেকে এক ক্যাব এসে হাজির হলো মুহূর্তে। ছুটলাম বিলিয়ন মার্কেটের দিকে। পাহাড় আর সাগরের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে পৌঁছে গেলাম কূয়া শহরে। বিলিয়ন মার্কেটে ঢুকেই বুঝতে পারলাম বিলিয়নিয়ার না হলেও বিলিয়ান মার্কেট থেকে কেনাকাটা করা যাবে। চন্দনা চা, কফি থেকে শুরু করে কসমেটিক সবকিছু কিনলো এখান থেকে। পুরো লাংকাউই ডিউটি ফ্রি জোন। তাই দাম আকর্ষণীয়।
মার্কেটিং করে আর শহর ঘুরে রাত ন’টায় ফিরছি হোটেলের দিকে। চারদিক মহাশূন্যের মতো সুনশান। সাগরের পাশ দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে রাস্তা। কোথাও কোথাও ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি পাহাড়। শহর থেকে হলিডে ভিলা রিসোর্ট এক ঘন্টার পথ। রাস্তায় তেমন কোন গাড়ীঘোড়াও নেই, আলোও নেই। এই নির্জন পথে আমরা চারজন। সাথে অপরিচিত ড্রাইভার। বিরাণ রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় আমার মনে হয়েছিল এই ড্রাইভার যদি ইচ্ছা করে যে সে এই নির্জন প্রান্তরে আমাদেরকে খুন করে লাশ সমুদ্রে কিংবা পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে রাখবে তবে তা খুব কঠিন কাজ হবে না। বন্দুকের গুলির শব্দও কোন মানুষের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে না। অথবা সে আমাদেরকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে যেখান থেকে আমাদের সর্বস্ব লুট করে আমাদের লাশ গুম করে ফেলা হবে অতি সহজ। আমার পকেট আর চন্দনার ভ্যানিটি ব্যাগ মিলিয়ে কম করে হলেও তিন হাজার ডলার। ভয়ে গা ছম ছম করা অস্বাভাবিক নয়। আমি আমাদের দেশের অবস্থাটা চিন্তা করতে থাকি। কোন দেশে ট্যুরিজম সেন্টার গড়ে তোলার পূর্ব শর্ত হলো নিèিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তা না হলে কেউ আসবে না সে জায়গায়। এশিয়ার বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র থাইল্যান্ডের পাটায়াতে বিদেশী যুবক শোভরাজ খুন করেছিল এক বিদেশিনীকে। তাই পাটায়ার ব্যবসা ক’ বছরের জন্য লাটে উঠেছিল। টাইট সিকিউরিটি ছাড়া যতো ভাল দৃশ্যই থাক না কেন কোন দেশ পর্যটন ব্যবসায় ভাল করতে পারবে না। ক’ বছর আগে এক জাপানীজ যুবক এসেছিল ঢাকায় হলিডে করতে। ভোর ছ’টায় কাওরানবাজার এলাকায় জগিং করতে যেয়ে পেটে ছুরিকাঘাত এবং মানিব্যাগ লুট। এমন দেশে কখনও পর্যটক আসে? রাত দশটার দিকে নির্বিঘেœ পৌঁছে গেলাম হলিডে ভিলাতে। নিশ্চয়ই এখন ডিনার খাওয়ার সময়। কেউ আর বাফেট ডিনার খেতে পছন্দ করলো না। ফেরার পথে তুলসী নামে একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট চোখে পড়েছে। দূর খুব বেশি নয়। হেঁটে গেলে বড়জোর পনের মিনিট। নির্জন রাস্তায় হেঁটে চলে এলাম তুলসী হোটেলে। এসেই দেখা হলো হোটেল বয় কালামের সাথে।
মাত্র ক’দিন আগে সে পেনাং থেকে লাংকাউই এসেছে। শহর হিসেবে পেনাং এর সাথে লাংকাউই-এর কোন তুলনাই চলে না। পেনাং মালয়েশিয়ার টিপটপ শহর। আর লাংকাউই নির্জন দ্বীপ। এখানে বড়জোর সাত দিন একনাগাড়ে থাকা যায়। এরচেয়ে বেশি নয়। তাই জানতে ইচ্ছা করলো কেন সে পেনাং থেকে এখানে চলে এলো। সে বললো তার কাছে কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। ভিসার মেয়াদ শেষ। পেনাং-এ অবৈধভাবে থাকা বিপজ্জনক। তাই চলে এসেছে সে এই নির্জন দ্বীপে ভাগ্যান্বেষণে। সকাল আটটা থেকে রাত একটা পর্যন্ত ডিউটি। বেতন ৮০০ রিংগিত অর্থাৎ ষোল হাজার টাকা। এক লক্ষ ষাট হাজার টাকা খরচ করে সে মালয়েশিয়া এসেছে টাকা রোজগার করতে। এতো কষ্ট করে মাসে রোজগার ষোল হাজার টাকা। বিয়ের এগার দিন পর বৌকে একা ফেলে কালাম এসেছে মালয়েশিয়া। গত দেড় বছরে বৌ’র সাথে যোগাযোগ শুধু কালেভদ্রে টেলিফোনে। রাত তখন বারোটা। হঠাৎ শুরু হলো বজ্রপাতসহ বৃষ্টি। রেস্টুরেন্ট থেকে ট্যাক্সি ক্যাব ডেকে দিল। স্বাভাবিক ভাড়া পাঁচ রিংগিত। আমাদের দেশ হলে ড্রাইভার যেতেই চাইতো না। অথবা সে এমন ঢং করতো যেন সে এই ঝমঝম বৃষ্টিতে আমাদেরকে লিফট দিয়ে কৃতার্থ করেছে। তারপর ভাড়া হাঁকতো তিনচার গুণ। কারণ তখন যা চাইবে আমরা তা দিতে বাধ্য। হোটেলে এসে ড্রাইভারের কাছে ভাড়া জানতে চাইলাম। সে মিটার দেখিয়ে পাঁচ রিংগিতই চাইলো। এক রিংগিতও বেশি দাবী করলো না। মনে মনে ভাবি এরা জাতে মালয়ি কিন্তু আদব কায়দায় ইউরোপীয়। মালয়েশিয়ার উন্নতি ঠেকায় কে? একটা জাতি যদি সৎ ও কর্মঠ হয় তবে তাদের উন্নতি আটকে রাখা যায় না। ডা: মাহাথির মোহাম্মদ তা প্রমাণ করে দিয়েছেন।
তিন দিন লাংকাউই ভ্রমণ করে আজ চলে যাচ্ছি কুয়ালালামপুর। আমাদের ফ্লাইট বিকেল চার টায়। কিন্তু আমার মাথা থেকে মাশুরির লিজেন্ড এখনও দূর হয়নি। যে কীরিচ দিয়ে মাশুরিকে হত্যা করা হয়েছে তা রক্ষিত আছে তামান কীরিচ নামক জায়গায়। জেনে নিয়েছি জায়গাটি এয়ারপোর্ট সংলগ্ন। তাই প্ল্যান করে রেখেছিলাম ফেরার সময় দেখে যাব ঐ মনুমেন্টটি। হোটেল থেকে চেক আউট করলাম দুপুর বারোটার দিকে। তারপর চললাম তামান কীরিচ।
এক সময় রাস্তায় তামান কীরিচ নামের অ্যারো সাইন দেখতে পেলাম। বুঝা গেল পৌঁছে গেছি গন্তব্যে। তামান কীরিচ একেবারেই জনশূন্য এলাকা। শুধু মাশুরির স্মৃতিসৌধ ছাড়া আশপাশে আর তেমন কিছু নেই। যে গাছের সাথে বেঁধে মাশুরিকে হত্যা করা হয়েছিল তার গোড়াটি বাঁধাই করা আছে। কীরিচের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে মনুমেন্ট। আমাদের ড্রাইভারটি বললো মূল কীরিচটি এই মনুমেন্টের ভেতর প্রোথিত করে রাখা হয়েছে। আমরা চারজন ঘুরেফিরে বেশ কিছুক্ষণ মাশুরির প্রাণদণ্ড কার্যকরের স্থানটি দেখলাম। সুদি আর অনি মাশুরির স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য বেশ কিছু ছবি তুলে নিলো। দুইশত বছরের পুরনো হলেও মাশুরির জন্য দুঃখ হলো। যে সময় মাশুরিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তখন সে ছিল দ্বিতীয় বারের মতো গর্ভবতী। নিজের জন্য নয় অনাগত সন্তানের জন্য প্রসব পর্যন্ত প্রাণদণ্ড স্থগিত রাখার অনুরোধ করেছিল মাশুরি। কিন্তু অন্য নারী মোহরা তাতে কর্ণপাত করেনি। গর্ভবতী নারীর প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয় এখানে নির্মমভাবে। মাশুরির মৃত্যুর পর পরই পুরো লাংকাউই এর শস্যক্ষেতে আগুন লেগে যায়। সেই পুড়ে যাওয়া ধান এখনো মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। মাশুরিকে হত্যার বছরেই রাজাও তার স্ত্রী মোহরা লাংকাউই থেকে বিতাড়িত হয়। ঐ বছরই সিয়ামিজ (থাই) রা লাংকাউই দখল করে নেয়। ১৯৮০ সালে মাশুরি বংশের সপ্তম জেনারেশনের নবজাতক আছিয়া নোয়াই লাংকাউই-এর মাটিতে পদার্পণ করে এ ভূমিকে অভিশাপমুক্ত করে আবার থাইল্যান্ডে চলে যায়। কারণ তারা আর লাংকাউইতে স্থায়ীভাবে থাকতে চায়নি। কিন্তু ২০০১ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের অনুরোধে মাশুরির পরিবারের সদস্যরা স্থায়ীভাবে লাংকাউইতে ফিরে আসে। ২০০১ সালের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী দ্বীপব্যাপী অনুষ্ঠান করে নিজে মাশুরির পরিবারকে বরণ করে নেন। এরপর থেকে লাংকাউইকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
মাশুরি বিনতে পানডাক মায়ার কাহিনীটি মালয়িরা পুরোপুরি বিশ্বাস করে। তাদের কাছে মাশুরি কোন ভোজবাজি, অলীক কিংবা কাল্পনিক আখ্যান নয়, এটি বাস্তব সত্য কাহিনী।
মাশুরির জন্য দু’ ফোঁটা চোখের জল ফেলে চলে এলাম এয়ারপোর্ট। ফিরে যাচ্ছি কুয়ালালামপুর। তিন দিন এই লৌকিক উপাখ্যানের দেশে থেকে যা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে গেলাম তা লাংকাউই না গেলে অন্যকে বুঝানো যাবে না। আমার এই ভ্রমণ কাহিনী পড়ে কেউ যদি লাংকাউই-এর রূপ-গন্ধ-বর্ণ-স্বাদকে অন্বেষণ করতে চান তবে তা হবে প্রায় অসম্ভব। লাংকাউই না যেয়ে তাকে অনুভব করার বিষয়টি হবে কমলালেবুর পরিবর্তে ভিটামিন-সি খাওয়ার মতো স্বাদহীন।