মধ্যরাতে কঙ্কালের সাথে

স্টেশনের লোহার গেটটা এক ধাক্কায় খুলে দৌড় দিলাম টিকিট কাউন্টার এর দিকে । অনেক রাত হয়ে গেছে, ট্রেন পাব কিনা জানিনা । টিকিট কাউন্টারের সামনে যেয়ে হতাশ হতে হল আমকে । বন্ধ । কিন্তু কিছু করার নাই আমার, এইখানে অপেক্ষা করা ছাড়া। একটা টুল দেখে বসে পড়লাম সেখানে । আজকে সকালেই জয়দেবপুর এসেছি একটা ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য । এম.বি.এ পাশ করেছি গতবছর । বহু জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছি । কখনই কোন রিপ্লাই আসেনি । সুতরাং কি হবে তাতো জানিই । বরাবরের মত কোন রিপ্লাই আসবেনা । কিন্তু তাও দিতে আসা, কিছুটা ফর্মালিটি আরকি । এসে পড়লাম বিপদে । ইন্টারভিউ দিতে দিতে বিকেল হয়ে গেল, সেখান থেকেগেলাম এক বন্ধুর বাসায়, সেইখান থেকে রাতের খাওয়াদাওয়াসেরে স্টেশনে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেল । এখন উল্লুকের মত বসে থাকাছাড়া কোন উপায় নাই । কখন ট্রেন আসবে কে জানে । বসে আছি আর মাঝে মাঝেই নিজের শরীরে জোরে থাপ্পড় বসাচ্ছি, মশা তাড়ানোর জন্য । বসে থাকতে থাকতে একটু ঝিমুনি এসে গেছিল । হঠাৎ কানেরকাছে কে যেন চিৎকার করে উঠল “ পেয়ে গেছিরে” । চিৎকার শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম আমি । এবার আমার চিৎকার দেওয়ার পালা । দেখলাম কিম্ভূতদর্শন দুইটা কঙ্কাল আমার সামনে দাঁড়ানো । “কি ভেবেছিলিরে টংরা, তুইলুকিয়ে থাকলে আমরা তোকে খুঁজে পাবনা?” একটা কঙ্কাল বলে উঠল ।

 “ টংরা কে”, বললাম আমি, ভয়ে ঘেমে উঠেছি । “কে আবার, তুই টংরা । তাড়াতাড়ি চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে যে”, বলল অন্য কঙ্কালটা । এই কঙ্কালটার আবার একটা পা নাই । “ কোথায় যাব?” “ যেন কিছু বোঝেনা, তোর আজকে বিয়ে না, তাড়াতাড়ি চল । ” । ” “ বিয়ে!”, চমকে উঠলাম আমি “কিসের বিয়ে, কার বিয়ে?”, গলা দিয়ে ফ্যাস ফ্যাস আওয়াজ বের হল । “তোর বিয়ে, বট গাছের পেতনীর সাথে । বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে আসলি, আর এখন কিছু বুঝতে পারছিস না?”, বলল একপায়াটা । “আমি তো মানুষ, আমার পেতনীর সাথে বিয়ে হয় কিভাবে? ”, বললাম আমি । “কে বলল তুই মানুষ, মড়া মানুষের ভিতর লুকালেই মানুষ হয়ে যায় নাকি?” “মড়া মানুষ? আরে মড়া পাচ্ছেন কোথায়, আমি তো জলজ্যান্ত মানুষ, দেখছেন না? মরলে আমি টের পেতাম না? ” খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল একপায়াটা । “ওরে, মানুষ কখন মরে তা কিসে টের পায়?” বলল সে ।“সে কি তাহলে কি সত্যিই আমি মরে গেছি?” চমকে উঠলাম আমি । “হ্যারে হ্যা, তুই মরে গেছিস রে, আর আমাদের টংরা তোর পেটের মধ্যে থেকে কথাবলছে । ” চোখে পানি চলে আসল আমার । হায়, জীবনেতো ধরতে গেলে এখনও কিছুই দেখিনি । প্রেমকরিনি, নাইট ক্লাবে যাইনি । সবইতো এখনও করাবাকি । শেষ পর্যন্ত কিনা এভাবেবেরসিকের মত মরলাম? “যেতে কি হবেই?”, একটু ভয়েভয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি । “ হবে না আবার?”, ধমক দিল প্রথম ভূতটা “ তোর না গায়ে-গু হয়ে গেছে । ” “গায়ে গু আবার কি?” “মানুষের যেমন গায়ে হলুদ হয়, তেমনি আমদের হয় গায়ে গু, কিছু বুঝিস না?” বলল প্রথম কঙ্কাল টা । হায়, সব আশা বুঝি শেষ । শেষপর্যন্ত বোধহয় আমকে বট গাছের পেতনীকেই বিয়ে করতেহবে । বট গাছের পেতনী দেখতে কেমন হবে কে জানে? তবু ও একটা শেষ চেষ্টা করা যাক । “ দেখুন আমি বোধহয় মরিনি, আমকে ছেড়ে দিন”, বললাম আমি । “ কোন ভূত যখন কোন মড়ার ভিতরে ঢুকে পরে, তখন সেই মড়াটার চেহারা সেই ভূতটারমতো হয়ে যায় । দেখনা, তোর চেহারাও টংরার মতো কেমন অকুৎসিত হয়ে গেছে । ”, বললএকপায়াটা । চেহারা আমার ভালোনা, এটা ঠিক । তাই বলে এমন অপমান? আমাকে বলে অকুৎসিত? মানে কুৎসিতের চেয়েও কুৎসিত? “ দেখেন ভাল হচ্ছেনা কিন্তু । আমি কোন টংরা ফংরা না”, একটু ঝাঁঝের সাথে বললাম আমি । “তুই যে টংরা না মানুষ, তার কোন প্রমাণ দিতে পারবি?” প্রমাণ? একটু ভাবলাম আমি । “হ্যা পারব । ”, বললাম আমি । “কি প্রমাণ?” “আমি কবিতা লিখতে পারব । আপনাদের টংরা কি কবিতা লিখতে পারে?” “ কবিতা?” আবার খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল একপায়াটা । “কবিতার নাম শুনলেও তো আমাদের টংরা অশ্বথ গাছে উঠে পালায় । ” “ব্যাস, এইতো প্রমাণ হয়ে গেল যে আমি টংরা না” খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি । “আগে প্রমাণ কর তুই কবিতালিখতে পারিস, তারপর বুঝব”,বলল প্রথম কঙ্কালটা, “তোর কবিতা কখনও ছাপা হয়েছে?” “আমার কবিতা এতটা উচ্চমানের, যে সেটা ছাপালে অন্য কবিরা আর সুযোগ পাবে না । তাই ছাপা হয়নি । একজনসম্পাদক নিজেরমুখে আমাকে একথাবলেছেন । ”গর্বের সাথে বললাম আমি । “দেখি লেখতো একটা কবিতা । আমার নাম নিয়ে একটা কবিতালেখ। ”, বলল প্রথম কঙ্কালটা । “নামকি আপনার?” জিজ্ঞেস করলাম আমি । “কানাবেল”, বলল প্রথম কঙ্কালটা । “আহা, নামের কি বাহার!”, মনে মনে বললাম আমি । যাই হোক ব্যাগ থেকে কাগজ কলম নিয়ে বসে গেলাম কবিতালিখতে । কিছুদূর লেখার পর জিজ্ঞেসকরল কঙ্কালটা, “কিরে লেখা হল?” “হ্যা শেষ । ” “পড়তো দেখি । ” একটু গলা খাঁকারি দিয়ে পরতে শুরু করলাম আমি, “তেল আছে, টেল আছে আর আছে কদবেল, মেল আছে, জেল আছে আর আছে পাস ফেল । খুন আছে, চুন আছে আর আছে বানডেল সবচেয়ে মহান হল কঙ্কাল কানাবেল । ” “ বাহ বাহ”, আনন্দে হাততালি দিয়েউঠল কানাবেল । “তাহলে প্রমাণ হলোতো যে আমি টংরা না?”, জিজ্ঞেস করলাম আমি । কি যেন বলতে যাচ্ছিল কানাবেল, কিন্তু তার আগেই চিৎকার করে উঠল একপায়াটা, “পেয়েছি পেয়েছি টংরাকে, ওই যে অশ্বথ গাছের উপরে । ” কানাবেল আর একপায়া দৌড় দিল গাছটার দিকে ।

29 May 2015 Recorded File Bhoot FM

Bhoot FM - Download Bhoot FM Recorded Episodes, Bhoot FM Download, Bhoot FM Recorded Version, Bhoot FM Recorded Episodes. Missed a Bhoot FM episode? Live abroad where Radio Foorti is not available? You can now download all Bhoot FM episodes and enjoy them at your convenient time.
দয়া করে ডানপার্শ্বের প্লে বাটন এ ক্লিক  করুন


সরাসরি ডাউনলোড করতে চাইলে নিচে ডউনলোড ফাইল এ ক্লিক করুন

Link 1
Link 2


বাঘ

প্রচণ্ড শীতে থরথর করে কাঁপছে রতন। গায়ে চাদর আছে, পাশে বেশ বড় করে আগুন জ্বালিয়েছে কিন্তু এতসব আয়োজন করেও মাঘ মাসের এই প্রচণ্ড শীতকে বশে আনা যাচ্ছেনা। রতন নিরালা আবাসিক এলাকার নাইট গার্ড। অল্প কিছুদিনআগে সে এই চাকরিটা নিয়েছে কিংবা বলা যায় নিতে বাধ্য হয়েছে। খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্য কিছু একটা তো করতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে এই চাকরিটা নিয়েছে। মোটেই সুখকর কোন চাকরিনা এটা। সারারাত ধরে ঘুমের বারোটাবাজিয়ে জেগে থাকতে তো হয়ই, তার উপর গত কিছুদিন ধরে যুক্ত হয়েছে বাঘের ভয়। গত পাঁচদিন হলো খুলনা শহরে প্রতি রাতে একটা করে লাশ পাওয়া গেছে। প্রতিটা লাশ পাওয়াগেছে ক্ষত বিক্ষত অবস্থায়। যেন কোন হিংস্রজন্তু প্রচণ্ড আক্রোশে ছিঁড়ে কামড়ে একাকার করেছে লাশগুলোকে। পেপারে এনিয়ে প্রতিদিন লেখালিখি হচ্ছে। ডাক্তারদের মতে কোন মানুষের পক্ষে এভাবে হত্যা করা সম্ভব না। শুধুমাত্র বুনো কিছু হিংস্র প্রাণী, যেমন- বাঘ,সিংহ, নেকড়ে বা হায়না এইধরনের প্রাণীর পক্ষেই এভাবেহত্যা করা সম্ভব। খুলনা কেন সারা বাংলাদেশের কোন বনেই সিংহ, নেকড়ে বা হায়না নেই। কিন্তু বাঘ আছে, এই খুলনার সুন্দরবনেই। ডাক্তারদের এই মতের উপর ভিত্তি করে সারা খুলনা শহর চষে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কোথাও বাঘের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে বাঘেরপায়ের ছাপ পাওয়া গেছে।হতভাগ্য লাশগুলোর আশেপাশেই বাঘের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। 

সুন্দরবন থেকে বিশাল ভৈরবনদী পার হয়ে খুলনা শহরে ঢোকা কোন বাঘের পক্ষে সম্ভব না। আর যদি কোনভাবে ঢুকেও থাকেতাহলে কোথায় লুকিয়ে থাকছে বাঘটা, সেটা এখন পর্যন্ত বের করাসম্ভব হয়নি। রাততো দূরেরকথা, মানুষ এখন দিনের বেলাতেও ঘরের বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছে। গতকাল রতন একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল। চায়ের দোকানের মালিক কাদের ভাইয়ের দেশের বাড়ি সুন্দরবনের পাশেই কোন গ্রামে। সেখানে একটা গল্পপ্রচলিত আছে, সুন্দরবনের মির্জা বাড়ি এলাকায় অনেক আগে মির্জা আসাদ ওয়ালি নামে এক জমিদার বাস করতেন। একটা পোষা বাঘছিল তার। বাঘটার হিংস্রতাবাড়ানোর জন্য প্রায়ই তাকে অল্প খাবার দেয়া হত। একদিন কোনোভাবে বাঘটাখাঁচা থেকে বের হয়ে আসে।দুর্ভাগ্যক্রমে জমিদার তখন তার বাগানে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। অভুক্ত বাঘটা ক্ষুধার জ্বালায় তার মনিবকেইআক্রমণ করে বসে। । জমিদারেরভাগ্য ভালো, মারা যাননি তিনি কিন্তু গুরুতর ভাবে আহত হন। মির্জা আসাদ ওয়ালি যেদিন আহত হন, সে রাতেই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। কথিত আছে এর পর থেকে প্রতি রাতে আকাশে চাঁদ উঠার পর থেকে তিনি বাঘের রূপ ধারণ করেন এবং প্রতিরাতেই একটা না একটা খুন করেন। মির্জা আসাদ ওয়ালিআহত হবার পর থেকে প্রতি রাতেই একজন করে গ্রামবাসিমায়া বাঘের আক্রমণে মারাযেতে থাকল। গ্রামের মানুষরা মায়া বাঘের ভয়েএকে একে গ্রাম ত্যাগ করতেলাগল। ধীরে ধীরে পুরো গ্রাম জনশুন্য হয়ে গেল। কথিত আছে আজও সেই মায়া বাঘ মির্জা বাড়ির আসে পাশে ঘুরে বেড়ায়। আজও সুন্দরবনের আশেপাশের গ্রামের মানুষ প্রায় রাতেই সেই মায়া বাঘের রক্তহিম করা গর্জন শুনতে পায়। কাদের ভাইয়ের মতে মির্জা আসাদ ওয়ালি রূপী সেই বাঘটা আজ প্রায় একশ বছর পর জঙ্গল ছেড়ে শহরে চলে এসেছেন। দিনের বেলায়মানুষরূপে থাকলেও রাতে তিনি বাঘের রূপ ধারণ করে একের পর এক হত্যা করে চলেছেন। রতন জানে এটা কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু বাঘতো একটা আছেই, যেটা প্রতি রাতে নির্মম ভাবে একটার পর একটা হত্যা করে চলেছে। আবার কেঁপে উঠল রতন। শীতেনা ভয়ে তা নিজেও ঠিক বুঝতে পারল না। হঠাৎ পিছনে একটা শব্দ শুনে চমকে ঘুরে তাকাল। নাইটগার্ডের ইউনিফরম পরা একজন লোক ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিরাতে দুজন করে নাইটগার্ড এই এলাকা পাহারা দেয়। এই লোকটাকে ও আগেকখনও দেখেনি। নতুন বোধহয়। লোকটা একটু হেসে রতনের পাশে এসে বসল। “নতুন নাকি? কবে জয়েন করলা”, রতন জিজ্ঞেস করল।বিদঘুটে ভাবে একটু হাসল লোকটা। “আজকেই”, বলল লোকটা। “নাম কি?” “জলিল” “ঘটনা শুনছ নাকি?”একটু উদাস ভাবে জিজ্ঞেসকরল রতন। “কি ঘটনা?” চোখ দুটো সরু করে জিজ্ঞেস করল জলিল । নিজে পুরোপুরি বিশ্বাস নাকরলেও কাদের ভাইয়ের কাছেশোনা ঘটনাটা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য করে বলে গেলরতন।কিছু কথা বানিয়ে যোগ করতেও ভুললনা। গল্প বলা শেষ করে লোকটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল রতন। হিংস্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। “আপনি এইসব বিশ্বাস করেন”, রাগত স্বরে জিজ্ঞাসা করল সে। “বিশ্বাস না করার কিছুই নাই, অনেক আজব ঘটনা ঘটে এইদুনিয়ায়”, দার্শনিকের মত জবাব দেয় রতন, লোকটাকেভড়কে দিতে পেরে মনে মনে খুশি হয়েছেসে। ক্রূর হাসি হাসল জলিল । চোখদুটো যেন মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠল। “ঠিকই বলেছেন অনেক আজব ঘটনা ঘটে এই দুনিয়ায়। যেমায়া বাঘের কথা আপনি ভাবছেন সে হয়তো আপনার আশেপাশেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে কিংবা মানুষ রূপে আপনার সামনেই রয়েছে, আপনি হয়তো বুঝতেও পারছেন না”, ধ্বক করে জ্বলে উঠল জলিলের চোখজোড়া। ভয়ের একটা শীতল শিহরন বয়ে গেল রতনের মেরুদণ্ড বেয়ে। একটা অশুভ চিন্তা উঁকি দিচ্ছে মনের ভিতরে। সত্যি না তো কাদের ভাইয়ের কাছে শোনা ঘটনাটা? হয়তো সত্যিই কোনমায়া বাঘ আছে, হয়তো মির্জা আসাদ ওয়ালিনামে সত্যিই কারও অস্তিত্ব আছেযে শহরে এসে প্রতি রাতে নির্মম ভাবে একটার পর একটা হত্যা করছে। জলিলের দিকে তাকাল রতন। কি যেন একটা অশুভ ব্যাপার আছে লোকটার চোখদুটোতে। হঠাৎ মনের মধ্যে উঁকি দিলভয়ংকর চিন্তাটা, বুঝতে পারল কি ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আছে সে। আবার জলিলের দিকে অকাল রতন। এখনও সেই ভয়ংকর হাসিটা লেগে আছে জলিলের ঠোঁটে। “তাহলে এতক্ষণেচিনতে পারলে আমি কে?”, বাজ পরল যেন লোকটার কন্ঠ থেকে। ঢোক গিলল রতন। বুঝতে পারছে কাদের ভাইয়ের কাছেশোনা গল্পটা মোটেও বানোয়াট না। কিন্তু বুঝেও আর কোন লাভ নাই, মৃত্যু ওর থেকে মাত্র দুইফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
আবার বিশ্রী করে হেসে উঠলজলিল,কিন্তু এবারের হাসিটা আর ভয়ংকর শোনাল না বরং মনে হল কিছুটা ব্যঙ্গ করে হাসছে জলিল । অবাক হয়ে তাকাল রতন। জলিলেরহাসি যেন থামতেই চায়না। হাসির দমকে চোখ দিয়ে পানি বেরহয়ে আসছে।“আপনি...আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন। আপনি তো দেখি মিয়া ভয়ে প্যান্ট খারাপ করে ফেলেছেন”, হাসতে হাসতে বললো জলিল। এতক্ষণে রতন আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারল। লোকটা এতক্ষণ যা বলেছে সবমিথ্যা। রাগ হল রতনের। কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। “তুমি কি মনে করেছ, তুমি যা বলছআমি তা বিশ্বাস করেছি? তোমার একটা কথাও আমি বিশ্বাস করিনি। শুধুমাত্র ভয়ের অভিনয় করেছি।” জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল রতন। খ্যাঁক খ্যাঁক করে আবার হেসে উঠল জলিল। বুঝিয়ে দিল রতনের কথা সে বিশ্বাসকরছে না। “আমি তোমার কথা এক বর্ণও বিশ্বাস করিনি”, ঝিক করে জ্বলে উঠল রতনের চোখ জোড়া, “আমি প্রথম থেকেই জানি তুমি মিথ্যা কথা বলছ,তুমি মায়া বাঘ না”। “আচ্ছা, তো কি করে বুঝতে পারলেন আমি মায়া বাঘ না”জিজ্ঞসা করল জলিল। “ আমি জানি তুমি মায়া বাঘ না”, ঘরঘর করে উঠল রতনের কন্ঠস্বর, “কারণমায়া বাঘ আমি নিজেই।” অবিশ্বাস ভরে রতনের দিকে তাকাল জলিল । হঠাৎ ধ্বক করে জ্বলে উঠল রতনের চোখ জোড়া, চোখ তুলেতাকাল পূর্ণিমার বিশাল চাঁদটার দিকে। ঘনঘন নিশ্বাস নিতে শুরু করল, যাঅতি দ্রুত রূপান্তরিত হল চাপা গোঙানিতে। চোখের কালো মণি বদলে গিয়ে হলুদরং ধারণ করল। হলুদ হয়ে উঠল চামড়া, শরীর ফুঁড়ে বেরুতে শুরু করল থোকা থোকা লোম। কান দুটো আকারেবড় হয়ে উঠল। ফাঁক হয়ে গেল রতনেরমুখটা, চোয়ালে ঝিকিয়ে উঠল ক্ষুরধার দাঁতের সারি। রূপান্তরের যন্ত্রণায় হাত দিয়ে মাটি খামচে ধরল রতন, চোখেরনিমিষেই ও দুটো পরিণত হল বিশাল রোমশ থাবায়। ধীরে ধীরে রতন পরিণত হল এক বিরাট রয়েল বেঙ্গল টাইগারে। বিকট এক গর্জন ছেড়ে জলিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লবাঘরূপী রতন ওরফে এককালেরপ্রতাপশালী জমিদার, মির্জা আসাদ ওয়ালি। আগুনটা একটু উস্‌কে দিল রতন। শীতটা যেন আজকে একটুবেশীই পরেছে। হঠাৎ পিছনে একটা শব্দ শুনে চমকে ঘুরেতাকাল। নাইটগার্ডের ইউনিফরম পরা একজনলোক ঠিকতার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।লোকটা একটু হেসে রতনের পাশে এসে বসল। “নতুন জয়েন করলা মনেহয়”একটু হেসে বলল রতন। “আজকেই”, প্রত্যুত্তরে বলল লোকটা। “নাম কি?” “ইদরিস।”“ঘটনা শুনছ নাকি?”, একটু উদাস ভাবে জিজ্ঞাসা করল রতন। “কি ঘটনা?”, জিজ্ঞাসা করল লোকটা। কাদের ভাইয়ের কাছে শোনা ঘটনাটা বলতে শুরু করল রতন।

রহিমার রহস্যময় বিয়ে

ঘটনার সময়কাল ১৯৪০। গ্রাম তো দুরের কথা, তখন অনেক মহকুমা শহরেও বিদ্যুতের নাম গন্ধ ছিলো না। রহিমার বাস কদমতলি গ্রামে। কদমতলি গ্রামের নাম শুনেছেন তো? ওই যে আমাদের পাশের গ্রামের শেষ প্রান্তে বড় যে আমবাগান ছিলো, তার পশ্চিমপাশের গ্রামটা। - এ কথা বলে মিজান সাহেব একটু দীর্ঘ থামলেন। মিজান সাহেব আমাদের পাশের বাড়ীতে থাকেন। বয়স প্রায় ৮০ ছুই ছুই। সন্ধ্যার পরআমাদের আড্ডা হয় তার দোতলা বাড়ীর ছাদে। মিজান সাহেবের ছাদ আবার একটু অন্ধকার। গাছের আড়ালের কারণে ল্যাম্পপোস্টের আলো পুরোপুরি পৌছায় না। একেবারেই ভুতুড়ে পরিবেশ।আজ হঠাত করে আড্ডায় মধ্যেভূতুড়ে অভিজ্ঞতার বয়ান শুরু হলো। এই বিষয়ে মিজানসাহেবের দেখলাম ব্যাপক আগ্রহ। তার নাকি জীবনে অনেক অদ্ভূতুড়ে অভিজ্ঞতাআছে। তার একটি আজ বলবেন। সবাই আগ্রহনিয়ে কান খাড়াকরে আছি। পরিবেশটাই ভুতের গল্প শোনার জন্য মানানসই। মিজান সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন। আমার দিকে ফিরে বললেন, বুঝলেন নাফিদসাহেব, ঘটনাটা আজও একটা রহস্য হয়ে আছে। যা বলছিলাম, রহিমার বয়স তখন ১৪। গ্রামে আমাদের প্রতিবেশী। 

তখনকার দিনে এই বয়সের আগেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেতো। রহিমার বিয়ে একটু দেরিতেই হয়েছিলো। মা বাবার আদরের ছিলো বলে দেরিতে বিয়ে দিয়েছিলো। রহিমার বিয়ে কার সাথে হচ্ছিলো, আমরা পরিস্কার জানতাম না। রহিমার বাবা ফকির দরবেশ টাইপ মানুষ ছিলেন। খেয়ালি প্রকৃতির। হঠাত করে তার এক মুরিদের পাল্লায় পড়ে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। বরের সম্পর্কে আগাম কিছুই আমাদের জানা ছিলোনা। রহিমার বাবাকে ভয় মিশ্রিত ভক্তি শ্রদ্ধা করতাম বলে কিছু জিজ্ঞেসও করা হয়নি কারো। ফকির দরবেশ মানুষ। কার উপর গোস্বা হয় কে জানে! বিয়েরসময় মাগরিবের পরে ঠিক হয়েছিলো। পাত্র পক্ষ মাগরিবের পরে অন্ধকার নামতেই হাজির হলো। বরের সাথে মাত্র দুইজন মানুষ। একজন রহিমার বাবার মুরিদ সেই মানুষটি, পাত্রের মামা। আরেকজন পাত্রের বাবা। এত কম বরযাত্রী আসাতে আমরা সবাই অবাক হলেও কিছু বললাম না। খেয়েদেয়া হুজুর কলেমা পড়ালেন।পাত্রের চেহারা দেখলাম তখন। চেহারাটা কেন জানি সুবিধার লাগলো না। চোখগুলো ঘোলাটো ঘোলাটে। প্রথম দর্শনেই আমাদেরকারো পছন্দ হলো না। কিন্তু কিছুই করার নাই। আমরা খেয়েদেয়ে বাড়ীতে চলে এলাম। পরের দিন ভোরে হইচই শুনে ঘুম ভাঙলো। রহিমাদের বাড়ীতে প্রচন্ড গোলমালের আওয়াজ পেলাম। এক দৌড়ে গিয়ে হাজির হলাম। দেখলাম রহিমা অজ্ঞান পড়ে আছে। সবাই তার মুখে পানির ছিটকা দিচ্ছে। জ্ঞান ফেরার পর সবার কথায় ঘটনা পরিস্কার হলো আমাদের কাছে। জানলাম, বরপক্ষের দুইজন বরকে রেখে রাতেই চলে যায়। রহিমার বাসর ঘরেযখন বর প্রবেশ করে, তখন রাত হয়েছে অনেক। গ্রামের বাড়ী। চারদিক ততক্ষণে নিশ্চুপ। শুধুঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। হারিকেনের মৃদু আলো জ্বলছে। বরের মুখ একবার মাত্র দেখেছিলো রহিমা। ঘোলাটে চোখ দেখেই ভয়ের একটা শিরশিরে অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরে। আরো ভালো করে দেখার আগেই বর হারিকেনের আলো এক ঝটকায় নিভিয়ে দিলো। তারপর নি:শব্দে রহিমার পাশে এসে বসলো। রহিমার কেন যেন অস্বস্তি লেগে উঠলো। তবুও কিছু করার নেই। এই ছেলেই এখন তার সবকিছূর মালিক। সহ্য তো করতেই হবে। কিন্তু ছেলেটি যখন তাকে জড়িয়ে ধরলো, হাতগুলোকেমন যেন লোমশ লোমশ লাগলো। গা সিড়সিড় করে উঠলো রহিমার। অস্বস্তিকর অনুভূতি নিয়েই স্বামীসঙ্গ হলো। তার পুরো শরীর কেমন যেন অসাড় হয়ে উঠলো। তান্ডব শেষে ক্লান্ত রহিমা মরার মত ঘুমালো। ভোরে যখন ঘুম ভাঙলো, পাশ ফিরতেই দেখলো তার বিছানা খালি। বাইরে তখন গন্ডগোলের শব্দ। রহিমার বাবা দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন। দরজা খোলার পরপরই তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেদে উঠলেন। তারপরের ঘটনা শুনেই রহিমাও অজ্ঞান। ঘটনা হলো, যার সাথে রহিমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো,তারা নৌকায় করে আগের দিন দুপুরে রওনা দিয়েছিলো। কিন্তু আসার পথে বিকেলে নৌকাডুবিতে পাত্র তার দুই সাথী সহ মারা যায়। সকাল বেলা তাদের লাশ ভেসেউঠে নদীতে। গ্রামের মনু মাঝি লাশগুলো পাড়ে নিয়ে আসে। - এই হলো ঘটনা। বুঝলেন নাফিদ সাহেব। এইটা এখনো এক রহস্য আমার কাছে। পাত্র যদি আগেই মারা যায়, রহিমার বাসর হলো তাহলে কার সাথে! আরো অবাক করা ঘটনা হলো, রহিমাপরবর্তীতে গর্ভবতী হয়। একটি সন্তানও হয়। ছেলে সন্তান। চেহারা অবিকল বাবার মতই। চোখগুলো ঘোলাটে ঘোলাটে ।

বটতলায় যখন নামলাম তখন রাত বারটা

বটতলায় যখন নামলাম তখন রাত বারটা। বাসটা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি অন্ধকারের সাগরে নিমজ্জিত হলাম। মিনিট দুয়েকের মত চোখ বন্ধ রাখলাম অন্ধকার মানিয়ে নেয়ার জন্য, তবুও আশেপাশের কিছু চোখে পড়ল না। কি ভয়াবহ অন্ধকার।

বেশ অনেকদিন পরে গ্রামের বাড়িতে আসছি। এখান থেকে দেড় দুই কিলোমিটার দক্ষিনে আমাদের গ্রাম। রিক্সাই একমাত্র বাহন। কিন্তু এত রাতে রিক্সা পাব কিনা সন্দেহ হল। বাড়ি যেতে আবার দুটি বিশেষ যায়গা পার হতে হয় যেগুলো গ্রামের কিছু লোকের ভাষায় ’দেও দানব’ এর আবাসস্থল। যদিও এসব কথা এ যাবৎকালে ফালতু বলে উড়িয়ে দিয়েছি। বিংশ শতাব্দীর এই দিনে এসব কথা হাস্যকর মনে হয়। কিন্তু আজ এই পরিবেশে কথাগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে। দুরে কোথায় যেন ঝি ঝি পোকা ডাকছে। সুনশান নিরবতার মধ্যে থেমে থেমে ডেকে ওঠা ঐ শব্দকে ভৌতিক ভয়ংকর শোনাচ্ছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। আমি আর ঝি ঝি পোকা। সাথে অন্ধকার।

এতক্ষনে আবছাভাবে সবকিছু চোখে পড়তে শুরু করল। পাকা রাস্তা থেকে দক্ষিন দিকে নেমে গেছে আমাদের প্রামের রাস্তা। আমি রাস্তায় নেমে পড়লাম। ছোট দোকানটি চোখে পড়ল; বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। পাশে যেখানে রিক্সা থাকার কথা সে যায়গাটা ফাঁকা। ভয়ে আমার গা গা ছমছম করছে। এখন কি করি? একটু ইতস্ততঃ করে ধীরে ধীরে সামনে সামনে এগুতে থাকলাম। হঠাৎ এক ঝলক আলোর স্ফুলিঙ্গ চোখে পড়ল। সর্বনাশ! ভুতের আগুন নয়তো? মৃদু গুনগুন শব্দ কানে যেতেই ভয়টা কিছুটা কেটে গেল। ভুত আর যাই করুক গুনগুন করে গান করে না; কোনদিন করেছে বলেও শুনিনি। আমি সাহস সাহস করে এগিয়ে যাই। একটা রিক্সা! সিটে বসে বিড়ি ফুকছে রিক্সাওলা। বিড়ির টানে যে আলো সৃস্টি হল তাতেই তার চেহারা পরিষ্কার দেখতে পেলাম। রোগা পাতলা শরীর – শুকনো মুখ। আশ্চর্য! বিড়ির আলো যে এতটুকু তা কখনো কল্পনাও করিনি। দিনের আলোয় কখনো বোঝা যায়না অন্ধকারে এই একটু বিড়ির আলো কত উজ্জল হয়ে জ্বলে!

আমাকে দেখে লাফ দিয়ে নেমে দাড়াল সে রিক্সা থেকে। বিড়িটা ছুড়ে ফেলে দিল। ’বাইত যাইবেন? উঠেন’ – আমি একটু অবাকই হলাম। চেনে নামি আমাকে? হতে পারে, গ্রামের অনেকের কাছেই আমি পরিচিত।

’আপনি হ্যারিকেন জালাননি কেন?’ – আমি জিজ্ঞেস করলাম।

’কমাইতে গিয়া সইলত্যা ভিতরে পইরা গেছে’ – রিক্সাওলা কৈফিয়াৎ দিল।

আমি রিক্সায় উঠে বসলাম। – ’অন্ধকারে রিক্সা চালাবেন কিভাবে? রাস্তা দেখবেন কিকরে?’

’অসুবিধা নাই। বিলাইএর চোখ আমার; অন্ধকারেও সব দেখবার পারি। আপনে শক্ত হইয়া বইসা থাকেন’

রিক্সা ঘুরিয়ে অদ্ভুত কায়দায় লাফিয়ে তার আসনে উঠে বসল রিক্সাওলা। কয়েক মুহুর্তেই দ্রুত চলতে শুরু করল রিক্সা। ঐ রোগা পটকা টিনটিনে শরীরে যে এত শক্তি তা ওকে দেখে বুঝতে পারিনি।

কিছু সামনেই ‘দেও দানবের’ আবাস্থল; বিশেষ যায়গা দুটির প্রথমটি। উত্তর পাড়া আর দক্ষিন পাড়ার ঠিক মাঝখানের কালভার্টটি। কালভার্টের দুই পাশে দুটো শিমুল গাছ – দুই পাড়ার লোকজন বুনেছিল। বিশাল আকৃতি নিয়ে দাড়িয়ে আছে গাছদুটি। দেখতেও হুবহু এক। আর চারিদিক বিস্তির্ন মাঠ, খেত খামার। সবাই বলে নিচ দিয়ে যাবার সময় শিমুল গাছ থেকে ঝাঁপ দিয়ে ঘাড়ের উপর আছড়ে পড়ে ’দেও’।

কিছুক্ষনের মধ্যেই উত্তর পাড়া পার হয়ে গেল রিক্সা। অন্ধকার থেকে আবছা আলোয় আসতেই বুঝলাম উত্তর পাড়ার শেষ বাড়িটি পার হলাম। কিছুদুরেই কালভার্ট।

আমি চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। সত্যিই ভয় পাচ্ছি। মৃদু ঝাঁকি অনুভুত হতেই বুঝলাম কালভার্ট পার হচ্ছি। একটু করে চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম ওপাশের শিমুল গাছটা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছি আমরা। মনে একটু সাহস ফিরে এল। একটা ঝামেলা তো পার হল!

পরবর্তী স্পট একটু সামনেই। ওখানটা অবশ্য একটু অন্য রকম। বাংলা ’দ’ অক্ষরের মত দুটো বাঁক নিয়েছে রাস্তা – চারপাশে বাঁশের ঝাড়। দিনের বেলায়ই বেশ অন্ধকার হয়ে থাকে। আর রাতে হলে তো কথাই নেই। বাশ ঝাড়ের মুখে ওখানেও বড় একটা শিমুল গাছ দাড়িয়ে। কাকতালীয় ভাবে এটিও একই রকম দেখতে।

রাতের অন্ধকারে গাছটিকে আরও ভয়াবহ দেখায়। মনে হয় বিশাল এক দৈত্য দাড়িয়ে আছে। এর সম্পর্কে নানা রকমের গল্প শুনেছি ছোটবেলায়। দিনের বেলায়ই যেতে গা ছমছম করে। রাতের বেলা ওখান দিয়ে গেলে নাকি ’বোবা’য় ধরে। বোবা বিষয়টা কি তা আমি এখনো কারো কাছে সঠিকভঅবে জানতে পারিনি। অনেককেই নাকি বোবায় ধরেছে এ পযন্ত। কিন্ত এখনো এমন কাউকে পাইনি যাকে বোবায় ধরেছে। সবাই শুধু শুনেই এসেছে।

ভয় কাটানোর জন্য অন্য কিছু ভাবতে বসলাম। বিকেলে রওনা হয়ে রাত বারটায এসে পৌছেছি। মাত্র ১০০ কিলোমিটার পথ। আশ্চর্য, ঢাকা থেকেই যদি তিন ঘন্টা সময় লাগে বের হতে তাহলে কেমন লাগে? ভীষন মেজাজ খারাপ হচ্ছে দেশের ট্রাফিক ব্যাবস্থার উপর।

অন্ধকারে রিক্সাওলা সাই সাই করে প্যাডেল মেরে চলছে। হঠাৎ মনে হল এতক্ষনে তো বাশঝাড় মানে দ্বিতীয় স্পটটা পার হয়ে যাবার কথা। বিষয় কি? আমি চারদিকে একটু খেয়াল করার চেষ্টা করলাম।

ঐতো সামনে আবছা ভাবে শিমুল গাছ দেখা যাচ্ছে; তার মানে আমরা দ্বিতীয় স্পটে ঢুকতে যাচ্ছি। আমি দাঁতমুখ চেপে জবুথবু হয়ে বসে রইলাম।

শিমুল গাছটা পার হবার পরেই আবার মৃদু ঝাকি খেল রিক্স্রা। মনে হল রিক্সাটা আবারো কালভার্ট পার হল। আশ্চর্য। কালভার্ট তো পার হয়েই এলাম। ঘটনাটা কি? আরে! এইতো এপারের শিমুল গাছটি; আবছা আলোয় দেখা গেল; পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। কি ব্যাপার? এমন হল কেন? নাকি ভুতের ভয়ে মাথার ভেতর ওলট পালট হয়ে গেল?

আমি সচেতন ভাবে তাকালাম। ছুটে চলেছে রিক্স্রা। একমনে চালিয়ে যাচ্ছে রিক্সাওয়ালা। কিছু জিজ্ঞেস করব? ইচ্ছে করছেনা। বেকুবি হয়ে যায়। আমি শহরের ছেলে। ভয় পেয়েছি শুনলে একথা রটে যাবে।

ঐতো সামনে আবছা অন্ধকারে আবারো শিমুল গাছে অবয়ব চোখে পড়ছে। পৌছে গেছি এবার বাশঝাড়ের কাছে। আমি সজাগ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছি আমার বাম দিকে, শিমুল গাছটা পারহয়ে গেল। তারপর আবারও মুদু একটা ঝাকি! আমারা তৃতীয়বারের মত কার্লভার্ট পার হচ্ছি! আমার সাড়া শরীরের রোমকূপে শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল। ভয়ংকর কিছু একটা ঘটে গেছে বা যাচ্ছে।

আমি রিক্স্রায় বসেই প্যাডেলরত রিক্সাওলার গায়ে হাত রাখলাম। বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আছে রিক্স্রাওলার শরীর। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমি চিৎকার করে তার পিঠে ধাক্কাতে লাগলাম – ’এই এই’

রিক্সাওয়ালা কেমন যেন গোঙানীর মত আওয়াজ করতে থাকল। মনে হল কে যেন তার মুখ চেপে ধরে রেখেছে। মনে হচ্ছে প্রানপণে রিক্সার হাতল ধরে রেখেছে সে।

হঠাৎ আমিও শরীরে কিছু একটা চাপ অনুভব করি। তবে কি আমাকেও? – আমার শরীরের রক্ত হঠাৎই গরম হয়ে যায়। ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমি হঠাং রেগে উঠি; আগেও কয়েকবার প্রমান পেয়েছি। আমি স্থান কাল পাত্র ভুলে চেচিয়ে উঠি। ’এই শুওরের বাচ্ছা ওকে ধরেছিস কেন ছাড়। ছেড়ে দে।’ চেচিয়ে উঠার সাথে সাথে আমার সাড়া শরিরে মনে হয়ে রাগের বিদ্যৃত ঝিলিক দিয়ে যায়। হঠাৎ ভয়ঙকর সাহসী মনে হয় নিজেকে। আজ ভুতের একদিন কি আমার একদিন!

’খাইয়া ফালামু শালা। ওকে ছাড় – ছেড়ে দে।’ – জানিনা কাকে উদ্দেশ্য করে আমার এই গালগাল!

হঠাৎ তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় কি এক বিরাট বোঝা যেন নেমে গেল আমার উপর থেকে। ’ঐ কি হইছে?’ – কারো গলা শোনা যায়। আবার সেই তীব্র চোখ ধাধানো আলো। একজন পথচারী! বোধহয় আমার চিৎকার শুনেছে দুর থেকে। হাতে ছোট্ট একটি টর্চ! এর আলোকেই এত তীব্র মনে হচ্ছিল!

সঙ্গে সঙ্গে রিক্সাওয়ালা যেন সংবিত ফিরে পায়। ব্রেক কষে অল্পক্ষনেই থামিয়ে ফেলে রিক্সা। আর একটু হলেই চলে গিয়েছিল খাদে! বেশ জোরে জোরেই দোয়া দরুদ পড়ছে। বেশ ভয় পেয়েছে বলে মনে হল।

আমি বলে উঠি ’না তেমন কিছু না’ ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মানতে পারছিনা। আবার বলতেও ইচ্ছে করছে না কাউকে এই মুহুর্তে। ’ভাই একটু টর্চটা ধরবেন?’ আমি পেছনে তাকিয়ে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকি।

পেছন থেকে লোকটি টর্চের আলো ফেলে। অল্প সময়ের জন্য চারিদিক আলোকিত হয়। সহসাই বুঝতে পারি আমরা একটু পেছনেই বাশঝাড় ফেলে এসেছি।

’এই চলেন, চলেন।’ – আমি আবার রিক্সাওলাকে তাড়া দেই। রিক্সাওয়ালা দ্রুত রিক্সা টানতে শুরু করে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে সরে পরা ভাল।

’বড় বাচা বাইচা গেছি গো।’ – রিক্সাওলা শব্দ করে বলতে থাকে। – ’আইজক্যা আমাবষ্যার রাত আমার মনেই আছিল না।’

’কেন আমাবষ্যা হলে কি হয়। ’ – আমি জিজ্ঞেস করি।

’আমাবষ্যায় দেও দানোরা শিকার করতে বাইর হয়। একলা পাইলে কথা নাই। ’

’ধুর এগুলো ফালতু কথা।’ – আমি অভয় দেবার চেষ্টা করি। ’বাড়ি গিয়ে ঘুম’দেন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।’ – মুখে বললেও মনে ভাবি – সত্যিই বোধহয় বড় বাচা বেচে গেছি।

’আইজকার পর থেকে আর রাইতে রিক্সা চালামু না।’ – নিজে নিজেই বলতে থাকে সে।

****************************

পরদিন একটু বেলা করে ঘুম ভাংল। গত রাতের কথা মনে পড়ল। দিনের আলোয় সবকিছু মনে হল মিথ্যা। ধেৎ খামোখাই ভয় পেয়েছিলাম নিশ্চয়ই। সত্যিই কি কালভার্টটা তিনবার পার হয়েছি? এও কি সম্ভব। দিনের আলোয় অবাস্তব মনে হচ্ছে সব। ভাবতে ভাবতে বাড়ি ছেড়ে রাস্তার কাছে দাড়ালাম। রাতে কাউকে কিছু জানাইনি। খামোখা ভয় দেখিয়ে লাভ আছে?

রাস্তায় পান্জাবী পড়ে টুপি মাথায় চাচাকে দেখে অবাক হলাম। কি হয়েছে? কোথায় যাচ্ছেন?

’আর বলো না। গতকাল রাতে ওই পাড়ার মোতালেব মারা গেছে। ওর বাড়িতে যাচ্ছি।’

কথাটা শোনার সাথে সাথে প্রচন্ড একটা ভয় ঘিরে ধরল আমাকে। ’মোতালেব কি রিক্সা চালাত?’ – আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

’আরে না ও রিক্স্রা চালাবে ক্যান। জুয়া খেইলা কুল পাইত না। আবার রিক্সা।’

তাই নাকি? – একটা পাষান ভার যেন নেমে গেল আমার মাঝ থেকে।

’হ, বিদেশে আছিল কয়েক বছর। কিছু কাচা ট্যাকা পয়সা নিয়া আসছে। তাই জুয়া খেইলা উড়ায় এখন। ’

’তা হঠাৎ মরে গেল যে?’ – আমি জিজ্ঞেস করি।

’আর বলিস না। গতকাল নাকি রাত বারটার দিকে জুয়া খেইলা বাড়ি যাইতেছিল বাশছোপ তলা দিয়া। ভুতে ধরছিল কিনা কে জানে। বাড়ি গিয়া জ্ঞান হারাইয়া পইড়া যায়। তারপর আর উঠে নাই।’

কথাটা কানে যেতেই আমার পৃথিবী দুলে উঠল। সেই লোক নয়তো? টর্চের তীব্র আলোয় যে চক্র থেকে আমরা উদ্ধার পেয়েছিলাম গত রাতে; ওকি সেই চক্রে পড়ে মরে গেল? দিনের আলোতেই আমি আবার চারিদিকে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। চাচাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হলনা।

“রাতের অ্যাম্বুলেন্স”

আজ কাজে আসতে কামালের একটু দেরী হয়ে যায় . এখন বাজে সকাল প্রায় ৯ টা ৪৫ মিনিট .হাজিরা খাতায় সই করতে করতে কামাল একবার আশে পাশে চোখ বুলায় তারপর ঝট করে হাজিরের ঘরে লিখে ফেলে ৯টা ৩০ মিনটি . তার পর পাশের টেবিলে বসা এক বুড়োকে লক্ষ্য করে বলে- বুঝলেন কলিম চাচা বউডার শরীর বেশি ভালা না . আট মাস চলতাছে . অনেক চিন্তায় আছি.বাসায় কেউ নাই যে দেখভাল করবো . কি যে করি ? একটু থেমে আবার বলে -আমারই সব করতে হয় . তার উপর টাকা পয়সার সম্যায় আছি . -একটা কামের লোক রাখতে পারো না মিঞা ? পাশের টেবিলে বসে থাকা ৬০ বছর বয়সের বৃদ্ব কলিম মিয়া কথাটা বলে কিছুটা থামে , তারপর আবার বলে – জানো তো পরপর তিনদিন লেট হইলে এক দিনের বেতন পানিতে যাইবো . তোমার এ মাসে ওলরেডি ৭ দিন লেট . মানে ২
দিনের বেতন নাই. ব্যাপারটা মাথায় রাইখো .

কামাল কিছু বলে না মাথা নাড়ায় . সে ব্যাপারটা জানে .
সরওয়াদি হাসপাতালের এ্যম্বুলেন্স ড্রইবার হিসাবে গত মাস দু’য়েক আগে যোগ দিয়েছে কামাল . ওর কাজ হলো সারাদিন এ্যম্বুলেস চালান . যেদিন কাজের চাপ থাকে সেদিন এতো বেশি থাকে যে খাওয়া দাওয়ার সময় থাকে না . আর যেদিন কাজের চাপ কম থাকে সেদিন দেখা দু’একটা ট্রিপ মারার পরই বসে বসে ঝিমোতে হয় . তবে কাজের মধ্যেই থাকতে বেশি ভাল লাগে কামালের . তার উপর কখন ও সখন ও দু’পয়সা উপরি পাওয়া যায় . শুরুতে রুগি ,লাশ পরিবহন করতে একটু খারাপই লাগত . কিন্তু এখন তা সয়ে গেছে . ও চিন্তা করে দেখেছে যাত্রী পরিবহন করার চেয়ে রুগি আর লাশ পরিবহন করাই নিরাপদ হাউকাউ চেচামেচি কম করে . সই করে এ্যম্বুলেন্সের চাবির জন্য দোতালায় উঠতেই শান্তি দিদির সঙ্গে দেখা হয়ে যায় . তিনি প্রায় দৈড়ে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের
দিকে যাচ্ছিলেন . শান্তি দিদি হাসপাতালের সিনিয়র নার্স . কামালকে বেশ স্নেহ্ করে . ঠিক কামালের মতো দেখতে নাকি তার এক ভাই ছিল .
- কি দিদি কি খবর ?
- ২১ নম্বর রুগির অবস্হা বেশি ভাল না রে . স্যারদের খবর দিতে গেছিলাম . তোর বউ কেমন আছে ? কোন চিন্তা করবি না আমরা আছি . শান্তি দিদি দাঁড়ায় না .
কামাল কিছু বলার সুযোগ না পেয়ে হেসে অফিস রুমে ঢুকে যায় . সেখান থেকে চাবি নিয়ে সোজা বাহার ভাইয়ের চায়ের দোকানে . চাবি নেয়ার মানে কামাল গাড়ি সহ রেডি . কল আসলেই চলে যাবে . বাহার ভাই এর দোকানে কামাল এলাহি ভাইকে দেখতে পায় . আরো কয়েকজনকে নিয়ে বসে চা খাচ্ছে আর হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলছে . এলাহি ভাই এই হাসপাতালের ড্রাইভার ইউনিয়নের নেতা . তার হুকুম ছাড়া হাসপাতালের একটা গাড়িও চলে না . তার কথাই আইন . কামাল কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বলে ভাই কেমন আছেন ?
সালামের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে এলাহি মিয়া বলে – কি ব্যাপার কামাল আজকাল থাকো কৈই ? ইউনিয়িন অফিসে আসো টাস না . শুধু কি রুগিগো সেবা করলে চলবো ? নিজের ভবিষ্যতের দিকে ও তো তাকাইতে হইবো, না কি ? সর্মথনের আশায় এলাহি মিয়া পাশে বসে থাকা অন্য সবার দিকে তাকায় . সবাই মাথা নেড়ে তাকে সর্মথন দেয় .
- লিডার কামাল মিয়ার তো বাচ্চা হইবো . পাশে বসে লম্বা মতো তেল চোরা জহির বলে .
-আবে কামালের বাচ্চা হইবো নাকি ? ক’ওর বউ এর বাচ্চা হইবো . আরেকজন কথাটা বলার সাথে সাথে সবাই হো হো করে হেসে উঠে . কামাল কিচ্ছু বলে না . মুখে হাসি হাসি একটা ভাব করে রাখে . যেন খুব মজা পাচ্ছে .
-বস . চাটা খাও . তয় ভাই বাচ্চা হওনের পর কিন্তু ইউনিয়নের জন্য সময় দিবা . আমি তো শালায় তোমগো লাইগা খাটতে খাটতে শেষ . আর যে কোন দরকারে আমার ফোন দিবা . তোমগো লাইগা আমার জান কোরবান . বলে এরাহি মিয়া দল বল নিয়া চলে যায় .
কামাল বুঝতে পারে আজকের দিনটা ওর বসে বসেই কাটবে . চায়ের দোকানে দীর্ঘ সময় বসে থাকার পর ও কোন কল আসেনা . কামাল উঠে ওর এ্যম্বলেন্সের কাছে চলে আসে . ১৭ নম্বর এ্যম্বুলেন্স . দরাজা খুলে ও এ্যম্বুলেন্সে উঠে রেডিও চালিয় কতোক্ষন খবর শুনে .
এমন সময় সোলেমান এসে একটা ঠিকানা দিয়ে যায় . গুলশান যেতে হবে . রুগী নিয়ে আসতে হবে . কামাল বেড় হয়ে যায় . যাবার সময় একটা কলা আর বন রুটি নিয়ে নেয় বাহার এর দোকান থেকে দুপুরের খাবার হিসাবে খাবে বলে . খাতায় লিখে রাখতে বলে ও টান দিয়ে গাড়ী নিয়ে বেড় হয়ে যায় . হাসপাতালের গাড়ি চালালে আরেকটা সুবিধা হলো রাস্তায় সাজেন্টের সঙ্গে ঝামেলায় পরতে হয় না . কথায় আছে এ্যম্বুলেন্সের সাইরেন শুনলে প্রধান মন্ত্রীর গাড়ীও নাকি সাইট দেয় . কথাটা অনেকটা সত্য .
দেশের অবস্থা খুব একটা ভাল না . হাসিনা-খালেদা দুজনই বন্ধি . কখন কি হয় বলা যায় না . তারাতারি গুলশান থেকে ফিরতে পারলেই দ্বায়িত্ব শেষ করে বাসায় ফেরা যায় . মায়া বাসায় একলা . দুবার এর মধ্যে ওর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে . মায়া বলেছে ও ভাল আছে . কোন সমস্যা নাই . তাই ও এখন অনেকটা নিশ্চিন্তে আছে . গুলশান থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় . দোতালায় চাবি জমা দেবার জন্য আসতেই কামাল খবর পায় শান্তি দিদি ওকে কয়েকবার খুঁজেছে . অফিস রুমে খবর দিয়ে রেখেছে যেন ও আসলেই যেন ৭ নম্বর ওয়ার্ডে চলে আসে .

(২)
৭ নম্বর ওয়ার্ডটা খুব বড় . ঢুকতেই হাতের ডান পাশে নাসদের বসার জায়গা . শান্তি দিদি সেখানেই বসে আছেন . ওকে দেখে বলেন- কামাল এদিকে আয় . তোর সঙ্গে কথা আছে .
-দিদি বাসায় যেতে হবে . তারাতারি কও কি কইবা . কামাল একটা খালি চেয়ার টেনে বসে পরে .
-তোর বউ কেমন আছে ?
-আছে কোনরকম . দিদি রাইত হইছে . কাজের কথা কও . বউডা একলা ঘরে . কামাল তারা দেয় .
-আরে বছ না ছেমরা . কাজ ছাড়া কি তোরে ডাকছি ? কামাল মাথা নাড়ে দিদি ঠিক বলেছ কাজ ছাড়া ডাকেনি . শুন ২১ নম্বর বেডের রুগীডা মারা গেছে . লাশ মর্গে আছে . তোরে একটু দিয়া আইতে হইবো .
-কি কও ? এ্যই রাইতের বেলা ? জাকিরার তো নাইট ,ও’রে কও ? কামাল চলে যাবার জন্য দাঁড়িয়ে যায় .
-আরে শুন ; শুন; তোর তো টাকা দরকার . মালদার পাটি ; পাথের খরচ বাদ দিয়াও মনে হয় হাজার পাঁচেক দিবো . জাকির গেছে সাভারে আসলে কমু . ও মনে হয় রাজি হইয়া যাইবো . সামনে তোর পোলা পাইন হইবো হাতে টাকা পয়সা দরকার তাই আমি তোরে কইলাম . এখন যাওয়া না যাওয়া তোর মর্জি .
পাঁচ হাজার ! কামাল একটু দ্বিধায় পরে যায় . আসলেই তো ওর হাতে তেমন টাকা পয়সা নাই . প্রতি মাসে মাটির ব্যাংটাতে এতোদিন যা জমিয়েছে সব মিলিয়ে হয়তো হাজার পাঁচেকই হবে . এ সময় পাঁচ হাজার টাকা হলে বাচ্চা হওনের সময় অনেক নিশ্চিত হওয়া যায় .
-কিন্তু দিদি মায়া তো বাসায় একলা . দেরী করলে ভয় পাইতে পারে .
-আরে ছেমরা কয় কি ? ভয় পাইবো কেন ? লাগলে আমি যাওনের সময় একবার দেইখা যামু . শান্তি দিদি খাতায় কিছু লিখতে লিখতে বলে .
- কৈই যাইতে হইবো ? মাথা চুলকাতে চুলকাতে কামল জিজ্ঞাসা করে .
-কুমিল্লা . শান্তি দিদি লেখা বন্ধ না করেই বলে .
-ও মা কও কি দিদি ? কুমিল্লা ! কামাল আতকে উঠে . তাইলে তো ফিরতে ফিরতে ভোর হইয়া যাইবো .
-আরে না . ভোর হইবো না . এ্যই ধর তিনটা চারইটা বাজতে পারে .
-হেইডা তো ভোরই . কাইল আবার ডিইটি আছে না ? কখন ঘুমামু কখন কামে আমু .
-কাইল ১২ দিকে আবি .সুপার স্যাররে আমি কইয়া রাখুম . কোন অসুবিধা হইবো না . শান্তি দিদি ফাইলটা আলমিরাতে রাখতে রাখতে বলে .
-একটা কথা কও তো দিদি তোমার এতো গর্জকে ? ভালাই পাইছো মনে হয় .
-আরে ছেমরা মর . আমার আবার গর্জ কি ? তুই যখন মরবি তখন তোর লাইগাও আমি মাইষের হাতে পায়ে ধরমু .
-আহা দিদি রাগ করো কেন ?
-শুন . দিদি কামালের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে . যে মরছে সে অনেক বড় লোক আছিল . বড়লোকগো যেমন খাসলত ভালা হয় না . এই ব্যাডারও তাই আছিল . শেষ বয়সে তিনডা বিয়া করছে . কচি কচি মাইয়া গুলি এই এক সপ্তাহ বুইড়াডার লাগি যা করলো . এখন মরার পরও লাশ নিয়া বইয়া আছে . তুই যাইয়া পৌছে দিয়ে আয় . তোর কাম শেষ . শান্তি দিদি ওর হাতে একটা সাদা খাম দেয় .
-কি এইডা ? কামাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে .
-কি আবার টাকা আর ঠিকানা যেহানে যাবি . যা গাড়িতে গিয়া ব.
-কিন্তু দিদি এতোটা পথ এই রাইতের বেলায় লাশ নিয়া একলা যাইতে পারুম না .
-আরে ছেমড়া একলা যাবি কেন . বুইড়ার তিন বউ যাইবো তোর লগে . দেখিস আবার না তুই বুইড়া হইয়া যাছ .নিজের রসিকতায় নিজেই শান্তি দিদি হেসে উঠে .
-কি যে কওনা দিদি ? আমি তাইলে গাড়িতে যাই .
-যা . আর শুন বউরে নিয়া চিন্তা করবি না . আমি তোর দিদি আছি . যা ভাগ .
কামাল বেড় হয়ে যায় . হঠাৎ করে টাকাটা পেয়ে মেজাজ ভাল হয়ে যায় . যেতে যেতে মায়ার সঙ্গে ফোনে কথা বলে . মায়াকে জানায় – ওকে এখন কুমিল্লা যেতে হচ্ছে , ফিরতে রাত হবে . মায়া যেন কোন চিন্তা না করে . যতো তারাতারি সম্ভব ও ফিরে আসবে .
কামাল নীচে নেমে দেখে লাশ ওর গাড়িতে তোলা হয়ে গেছে . মনির মিয়া গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে .
এতো ভারী কারো শরীর হয় ? চাইর জন মিল্লাও তুলতে যে কষ্ঠটা হইলো . কামালের দিকে তাকিয়ে হাত ঢোলতে ঢোলতে কথা গুলো এক নি:শ্বাসে বলে মনির মিঞা .
-অনেক ভারী নাকি ? পাল্টা জিজ্ঞাসা করে কামাল তাকায় এ্যম্বুলেন্সের ভেতরে . বাম পাশের বেডের উপর লাশটা রেখে সাদা একটা চাদর দিয়ে লাশটা ডেকে দেওয়া হয়েছে . মিনির মিঞা বাম দিকের দরজা বন্ধ করে দেয় . কালো বোরকা পরা লম্বা মতোন দু’জন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির পাশে . একবার কামালের দিকে তাকিয়ে দু’জন নীচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকে . কামালের কান পর্যন্ত সে কথার আওয়াজ পৌছায় না . কাগজ নিয়ে আরেক জন বোরকা পড়া মহিলা কামাল এর কাছে এসে বলে – আপনিই কি যাবেন ভাই ?
-কামাল উপরে নীচে হা সূর্চক মাথা নাড়ে .
-তা হলে চুলুন রওনা হই . মহিলা মিনির মিয়ার হাতে কয়েকটা একশ টাকার নোট দিয়ে অন্য দুজন মহিলার দিকে তাকিয়ে বলে – কৈই তোমরা আস .
সবাই উঠে বসতেই কামাল এ্যম্বুলেন্স ছেড়ে দেয় . ঘড়িতে তখন বাজে কাটায় কাটায় রাত ১২ টা বাজে .

(৩)
রাস্তায় খুব একটা গাড়ি নেই . সোডিয়াম বাতির আলোয় পথ ঘাট কেমন ভৌতিক মনে হচ্ছে . কামাল এমনিতে ভুত প্রেত বিশ্বাস করে না . তবু এ নির্জন রাতে কেন যেন ওর শরীরে কাটা দিয়ে যায় . গাড়ির গতি ঘন্টায় ৬০ রাখে কামাল . মনে মনে ঠিক করে কোন অবস্থাতেই গাড়ির গতি ৬০কি.মি: এর উপড় নেবে না . কামালের শশুরই ছিল ওর ওস্তাদ . সে শিখিয়েছে রাতের বেলা রাস্তা ঘাট যতোই ফাঁকা হোক না কেন একটা নিদিষ্ট গতিতে গাড়ী চালালে কোন এক্সিডেন্ট হয় না . কামাল কথাটা বিশ্বাস করে . তাই আগে বাগে মনে মনে গাড়ির গতি ঠিক করে নেয় ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটার .সংসদ ভবন এর সামনে আসতেই বৃষ্টি শুরু হলো . কামাল মনে মনে বলে- বৃষ্টি হবার আর সময় পেল না . কামাল গাড়ীর গতি আরো কমিয়ে আনে . আসাদ গেটে আড়ং এর সামনে আসতেই সিগনাল পরে গেল . কামাল একবার ভাবলো টান দিয়ে চলে যাবে কিনা ? কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলো; না . অস্থির হবার কিছু নাই .
ও গাড়ী থামিয়ে গ্রীন বাতির জন্য অপেক্ষা করে . রাস্তা প্রায় ফাঁকা . কোন জন মানব নেই . ডানে বামে তাকালে ওর কেমন একটা গা ছমছম করে উঠে . দুর ! যতোসব ফালতু চিন্তা ভাবনা . এক কিলোও আসতে পারলাম না আর ভুতের চিন্তা পেয়ে বসেছে . নিজেক নিজেই সান্তনা দেয় কামাল . হঠা. বাম পাশের জানলা দিয়ে একটা মুখ উকি দিতে চমকে উঠে চিৎকার করে কামাল কে ? কে ?
জানালায় দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে আছে এক বুড়া . মাথায় এলোমেলে সাদা চুল . দু’হাত দিয়ে জানালার কাঁচ চেপে আছে . দাঁত গুলোও কেমন ফাঁক ফাঁক . লোকটা বলে উঠে- দে ; দে; টাকা দে . ভাত খামু টাকা দে .
মেজাজ খারাপ হয়ে যায় কামালের . মনে হয় নাইমা দুইটা চড় মারে . হারমজাদা ভিক্ষা চাওনের আর কোন সময় পায় না . মর যাইয়া . ও সাট ফাঁক করে বুকে থুতু দেয় .
মনে মনে গজগজ করলেও বুক পকেট হাতরে পাঁচ টাকার একটা নোট বেড় করে লোকটার দিকে বাড়িয়ে ধরে . লোকটা টাকা না নিয়ে বলে -ভাগ . ভাগ . তারাতারি ভাগ .
কথার আগা মাথা বুঝতে পারে না ও . কামালের কাছে লোকটাকে করে হয়তো পাগল- টাগল হইবো . ঠিক এই সময় ওর পেছনের ছোট জানলায় টোকা দেবার শব্দ হয় . কামাল ওর ঠিক পিঠ লাগোয়া যে জানালাটা সেটা একটু ফাঁক করে ও ০পেছনে না তাকিয়েই বলে- জ্বি বলেন ?
-কি হয়েছে ? পেছন থেকে তিন জনের একজন জিজ্ঞাসা করে .
-না কিছুনা .
সিগনাল ছেড়ে দেওয়ায় কামাল গাড়ী টানদেয় . কামাল বাম পাশের মিররে তাকিয়ে বুড়োটাকে আর দেখতে পায় না . মনে মনে ভাবে আরে গেলো কোথায় ? ও একটু সামনে ঝুকে ফুটপাতটা দেখতে চেষ্টা করে ;কিন্তু বুড়োকে আর দেখতে না পেয়ে বেশ অবাক হয় ও ; তারপর ফামগেটের দিকে টার্ন্ নেয় .
পেছন থেকে ফিস ফিস করে কথা বলার শব্দ কানে আসে কামালের . এই নিরবতায় তাতে ও কিছুটা সাহস পায় কামাল . মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ি শো শো করে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে . রাতে রাস্তায় বেশির ভাগ ট্রাকই চলে . দানবের মতো ট্রাকগুলি ঘোত ঘোত শব্দ করে চলে যায় . সায়দাবাদ ; যাত্রাবাড়ি হয়ে কামাল গাড়ি চালাতে থাকে শনির আকড়া দিয়ে কুমিল্লার দিকে . এ রাস্তাটা ওর বেশ পরিচিত . একটানা বৃষ্টি হচ্ছে . মনে হয়ে আজ সারা রাতই হবে . মাঝে মাঝে বিকট , শব্দে বিদ্যুত চমকাচ্ছে . শীত; শীত একটা ভাব চলে এসেছে . কামাল পানির বোতল খুলে পানি খায় . আশে পাশের দোকান পাট সব বন্ধ . আজ মনে হচ্ছে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও কম . পেছন থেকে আবারও টুক টুক করে শব্দ হয় .
- জ্বি বলেন ? কামাল মাথাটা একটু পেছনে নিয়ে বলে .
-আমরা একটু নামবো ? এক জন বলে . কামাল অবাক হয় .
-এখানে ?
-জ্বি . আপনি কি একটু থামেন .
-মনে হয় দাউদকান্দি এসে পরেছি . সেখানে থামলে হতো না ?
-না . সামনের বড় গাছটার কাছে থামুন . পেছন থেকে অন্য একটি কন্ঠ বলে উঠে . কথাটা আদেশেয মতো শুনার ওর কাছে . কামাল এ্যম্বুলেন্সটা রাস্তার পাশে একটা বড় গাছের গা ঘেষে দাঁড় করিয়ে দেয় . পেছনের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ও জানালাটা দিয়ে পেছনে তাকায় . আধো আলোয় যা দেখতে পায় তাতে কামাল এর মাথা ঘুরে উঠে . সিটের উপর মৃত ব্যক্তি বসে আছে . শুধু বসেই নেই ; হাত নেড়ে নেড়ে কি যেনো বলছে . ও প্রচন্ড রকমের ভয় পেয়ে যায় . কামল পেছন থেকে চোখ সরিয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চেষ্টা করে . সামনে তাকালে দু’ছায়া দেখতে পায় ও . কোন শরীর নেই . শুধু বোঝা যাচ্ছে দেহের অস্তিত্ব . বাতাসে ভেসে ভেসে ছায়া দু’কামালের দিকেই আসছে . ভয়ে ওর জান বের হয়ে যাবার জোগার . মনে হচ্ছে মরে যাবে . নিজেকে সিটের সঙ্গে চেপে রাখে ও. মনে হচ্ছে নিজেকে সিটের ভেতর ডুকিয়ে ফেলতে পারলে ভয় কিছুটা কমে যেতো . মনে মনে আল্লাহ্ ; আল্লাহ্ করতে থাকে . ছায়া দু’টো ওর পাশ দিয়ে পেছনে চলে যায় . পেছন থেকে হঠাৎ হাসির শব্দ ভেসে আসে . কামাল সাহস সঞ্চয় করে আবার পেছনে তাকায় .
লাশটা গাড়ি থেকে নেমে মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে . শরীরে জড়ানো মুদ্দারের কাপড় এলোমেলো ঝুলে আছে . লোকটার হাতে সাদা কাপরের একটা পুটলির মতো কিছু . দু’জন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে লোকটার ঠিক সামনে . একজন পুটুলিটি একটু ফাঁক করেতেই কামাল একটি শিশুর মাথা দেখতে পায় .
লোকটা পুটুলিটা গাড়ির ভেতরে ছুরে মারে . প্রায় সাথে সাথে হুরমুর করে সবাই গাড়িতে উঠে পরে গাড়িতে. কামালের শরীর শক্ত হয়ে গেছে . একবার ভাবলো গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দেবে কিনা . কিন্তু কোথায় যাবে ? তার চেয়ে ভাল কিছু না দেখার ভান করে থাকলে হয়তো জানে বেচে যাওয়া যাবে . ও মনে মনে প্রার্থনা করে আল্লাহ্ বাঁচাও . পেছন থেকে টোকা দেবার শব্দ আসতেই কামাল চমকে উঠে – গাড়ি চালাল . ভারী এটা কন্ঠ বলে . কামাল চাবিতে হাত দিতেই গাড়ি স্টাট হয়ে যায় . কামালের মাথা কাজ করছে না . গাড়ি রাস্তায় উঠার সময় সাইড মিররে দেখতে পায় ছায়া দু’টো এখনও দাঁড়িয়ে আছে . হাতে ধরে আছে সাদা মতো দু’টো পুটুলি . এখন আর বৃষ্টি পড়ছে না ; তবে মাঝে মাঝে বিদ্যূত চমকাচ্ছে . মেইন রাস্তা ধরে গাড়ি চালাচ্ছে কামাল . ও চালাচ্ছে না বলে গাড়ি নিজে নিজে চলছে বললেই ভাল শুনায় . কেননা এই মুর্হুতে গাড়ির উপর ওর কোন কন্টোল নেই . ও শুধু চুপচাপ বসে আছে . গাড়ি নিজে নিজে চলছে . পেছন থেকে চুক চুক শব্দ ভেসে আসছে . কামাল নিজেকে সামলে সাহস সঞ্চয় করে আবার পেছনে তাকায় . দেখতে পায় দু’জন করে দুপাশে বসে সবাই সামনের দিকে ঝুকে বাচ্চাটাকে খাচ্ছে।

বর্ষণ মুখর একটা সন্ধ্যা

৭ টা বেজে ৩১ মিনিট।
সেই সকাল থেকে ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। ইউনুস মিয়া তার বাগান বাড়ির পাশে যে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট
আছে সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। জমাট অন্ধকারে একা, মাথার উপর শরিফ মার্কা ছাতা ধরা। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। ভয়ে বেচারার মুখ পাংশু হয়ে আছে।
গ্রামে বিদ্যুৎ থাকলেও ইউনুস মিয়া তার এই বাগান বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ লাগান নাই। কারন এতে তার বড় ভাই ইউসুফের কড়া নিষেধ আছে। ইউসুফ আলো সহ্য করতে পারেন না, তার অন্ধকার খুব প্রিয়।
পুকুর ঘাটে দুই পা তুলে ইউসুফ বসে আছে, দুই হাত বুকের সামনে কাঙ্গালের মত ভাঁজ করে ধরা। একটা মাত্র আধ ছেঁড়া লুঙ্গি পরা সে। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছে। কপাল বেয়ে পানি নামছে সরু ধারায় সে দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই, ইউসুফের মেজাজ অনেক বেশি কড়া। এই যেমন এখন খুব কড়া হয়ে আছে ছোট ভাই ইউনুসের উপর।
ইউনুস একটু কেশে আবার বলল “ভাইজান, মিসির আলি নামের এক ভয়ানক বুদ্ধিমান মানুষ আমার বাড়িতে এসেছেন, আমি ভাবতেছি আপনার সমস্যার কথা উনাকে বলব”।

ছোট ভাইয়ের ঔদ্ধত্তে ইউসুফ একটু বিরক্ত হলেন। চোখ তুলে চাইলেন ছোট ভাইয়ের দিকে। বড় ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা ভয়ে হিম হয়ে গেল ইউনুসের। এই অন্ধকারেও বিড়ির আগুনের মত জ্বলছে ইউসুফের চোখ।
ইউসুফ শ্লেষ মেশানো কণ্ঠে বললেন, আমার কোন সমস্যা নাই। তুমি ওকে বলতে পার, তবে লাভ নাই। গতবার তো ঐ স্কুল মাস্টারকে বলচিলা। মনে নাই ঐ স্কুলের মাস্টারকে কিভাবে মারছিলাম? বলেই কেনা কেনা কণ্ঠে উচ্চস্বরে হেসে উঠল ইউসুফ। সেই হাসি যেন ইউনুসের বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল।
ইউনুস অতিদ্রুত বলে উঠল, “মিসির আলি সাহেব ভয়ানক বুদ্ধিমান, সে ঐ স্কুল মাস্টারের মত বোকা না, আপনি তার বুদ্ধির সাথে পারবেন না”।
ইউসুফ একদলা থু থু ফেলল ঘাটের পাকা ফ্লোরে। তারপর বলল “ও আচ্ছা, তাই নাকি? ঠিক আছে তাকে যেভাবেই হোক এখানে নিয়া আস। দেখা যাক”।
বলেই ইউসুফ আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে পুকুরের পানিতে নেমে গেল। হাঁটু পানি থেকে কোমর পানি, কোমর থেকে গলা- একসময় পুরো শরীর ডুবে গেল পুকুরের কাল জলে।
ইউনুস কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পুকুরের দিকে তারপর অন্ধকার বাগান বাড়ি থেকে ধিরে ধিরে পা বাড়াল মূল বাড়ির দিকে।
মিসির আলি সাহেব টিনের তৈরি আধাপাকা ঘরের বারান্দায় বসে আছেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে টিপটিপ করে। মিসির আলী সাহেবের টিপটিপ বৃষ্টিই খুব পছন্দ। টিপটিপ বৃষ্টির দিয়েছেন অলস বৃষ্টি! বয়সের কারনে তার নিজের গতিও একটু মন্থর হয়ে গেছে- আর সেই কারনেই অলস জিনিস ইদানিং কালে ভাল লাগছে তার। লক্ষন ভাল না।
গ্রামে গ্রামে এখন বিদ্যুতের ছড়াছড়ি, এই বাড়িতেও বিদ্যুৎ আছে। তবে মিসির আলি সাহেব বারান্দার লাইট অফ করে দিলেন। কারন বিদ্যুতের আলোয় বৃষ্টি দেখতে ভাল লাগেনা। কই যেন পড়েছেন চাঁদের জ্যোৎস্না দেখতে হয় খোলা মাঠে আর রাতের বৃষ্টি দেখতে হয় অন্ধকারে বসে! মিসির আলী অনেক চেষ্টা করলেন কথাটা কার মনে করতে কিন্তু পারলেন না। স্মৃতি বেঈমানি কারা শুরু করে দিয়েছে। লক্ষন ভাল না।
বেতের চেয়ারে দুই পা তুলে বসলেন মিসির আলি। হাতে ধোঁয়া উঠা এক কাপ লাল চা। চায়ে একটু লবন দেওয়া, তবে খেতে ভালই লাগছে তার।
মিসির আলি একটা সিগারেট ধরালেন। বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তারপর হঠাৎ একটা কবিতার দুই লাইন আবৃতি শুরু করলেন “আয় বৃষ্টি ঝেপে, ধান দিব মেপে” এই দুই লাইনই উনি আবৃতি করতে থাকলেন।
মিসির আলী এই পুরা কবিতাটা মুখস্থ পারেন, তার স্মৃতি শক্তি ভাল। তবুও কেন তিনি শুধু এই দুই লাইন আবৃতি করছেন তা বুঝতে পারলেন না।
এই অজপাঁড়া গাঁয়ে এসেছেন একটা বিয়ের দাওয়াতে, কিন্তু শহরে ফেরার আগেই বৃষ্টি শুরু। রাস্তায় পানি উঠে যাওয়ায় বাস চলাচল বন্ধ, তাই শহরে ফিরতে পারেন নি। বিয়ে বাড়িতে অনেক লোকজন। তাদের থাকার বেবস্থা হল প্রতিবেশিদের বাড়িতে। মিসির আলীর দায়িত্ব পড়ল ইউনুস সাহেবের ঘাড়ে।
ইউনুস সাহেব একজন অবস্থা সম্পন্ন মানুষ। গঞ্জে বিরাট দোকান পাট আর গ্রামে তো জমিজমার অভাব নাই। সব অবস্থা সম্পন্ন মানুষের মধ্যে যেমন একটু অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায় ইউনুস সাহেবও তার বেতিক্রম নন। পঞ্চান্ন বছরের এই লোকটি কখনই মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেন না!
এটা নিজে মিসির আলী একটা লজিক দাঁড় করেছেন। হতে পারে এই লোকটির পুরানো পাপ আছে মনে, তার ভয় হয় তার চোখের দিকে তাকালে সবাই বুঝে ফেলবে যে পাপটা উনিই করেছেন!
ইউনুস সাহেবকে নিয়ে এইধরনের চিন্তা করেছেন বলে মিসির আলী একটু লজ্জিত হলেন। ইউনুস লোকটা যথেষ্ট অমায়িক এবং মিশুক।
মিসির আলির সিগারেট শেষ হয়ে গেল, তিনি আবার একটা সিগারেট ধরালেন। চায়ের খালি কাপটা মেঝেতে রাখলেন। তারপর ঘড়ি দেখেলেন, রাত ৯ টা। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। টিনের চালে শব্দ হচ্ছে অবিরত। ইউনুস সাহেব মিসির সাহেবের ফরমাশ খাটার জন্য পাশের বাড়ির একটা ছেলেকে ডেকে এনেছেন। ছেলের নাম মতিন। তবে মতিন এই মুহূর্তে বারান্দার মাটিতে বিছানা পেতে শোয়ার সাথে সাথেই গভীর ঘুমে চলে গেল। গ্রামের মানুষ খুব দ্রুত ঘুমাতে পারে। মতিন ঘুমে বিছানায় কাত হয়ে ফোঁস ফোঁস করে ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত মানুষের দিকে তাকাতে ভাল লাগে মিসির আলির। কারন সেই সময় মানুষের মুখ থেকে সকল দুশ্চিন্তা সরে গিয়ে স্বর্গীয় আবেশ চলে আসে। মিসির আলি পরম মমতায় তাকালেন মতিনের দিকে। পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা।
মিসির আলি ঠিক করলেন ইউনুস সাহেবকে বলে একে মিসির আলি ঢাকায় নিজের কাছে নিয়ে যাবে। তিনি ছেলেটিকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবেন। তবে ছেলেটির পড়াশোনায় আগ্রহ একেবারে কম। গ্রামের স্কুলে যায় মাসে দুই তিন দিন, এখনো সে ক্লাস টু পাশ দিতে পারে নাই। সে গত ৪ বছর ক্লাস টু তে, এটা নিয়ে সে গর্বিত। তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়-“কিরে মতিন কোন ক্লাসে পড় তুমি??”
মতিন অনেক গর্ব করে উত্তর দেয় “ কেলাশ টু তে পড়ি”!!
সে ফেল করবে তবু স্কুল ছাড়বে না, আবার স্কুলে নিয়মিত যাবেও না।
এমন সময় ইউনুস সাহেব বারান্দায় ঢুকলেন। লোকটা পুরোপুরি ভিজে গেছেন। মিসির আলী একটু অবাক হলেন কারন ইউনুস সাহবের হাতে একটা প্রায় নতুন ছাতা আছে! তবে মিসির আলি কিছু বললেন না। শুধু চেয়ার থেকে পা নামিয়ে বসলেন।
“স্যার, আপনে বসেন, পা নামানোর দরকার নাই”,বললেন ইউনুস সাহেব।
মিসির আলি একটু বিব্রত বোধ করলেন, এই বয়সের একজন মানুষ তাকে স্যার বলে ডাকে এটা শুনতেও একটু অন্যরকম লাগে।
মিসির আলি মৃদু হেসে বললেন- সমস্যা নেই। আপনি যান, কাপড় চেঞ্জ করেন, ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
ইউনুস সাহেব ভিতরে চলে গেলেন, মিসির আলি আবার পা উঠিয়ে আরাম করে বসলেন।
একটা মজার ব্যাপার হল ইউনুস সাহবের এত বড় বাড়িতে শুধু ইউনুস সাহেব একা থাকেন। বিয়ে করেছিলেন তবে বউ বিয়ের দুই মাসের মাথায় চলে যায় আর ফেরত আসেনি, ইউনুস সাহবও বিয়ে করেন নি। পাশের বাড়ি থেকে মতিনের মা এসে রান্না করে দিয়ে যায়। এত বড় বাড়িতে ইউনুস সাহব কিভাবে থাকেন তা ভাবতেই একটু অবাক হলেন মিসির সাহেব। কোথায় যেন একটু অস্বাভাবিকতা আছে একটু। মন বলছে “ সাবধান, মিসির আলি সাবধান”!!
রাত ১০ টা।
সামনা সামনি দুইটা বেতের চেয়ারে বসে আছেন মিসির আলি আর ইউনুস সাহেব। যথারীতি ইউনুস সাহবের চোখ নিচের দিকে। পাশে এখনো মতিন ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। বারান্দায় দুটা পাঁচ টাকা দামের মোম বাতি জ্বলছে। বাইরে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে ধিরে ধিরে। বাতাসে মোমের শিখা তিরতির করে কাঁপছে। বারান্দায় গভির নিস্তব্ধতা ভর করেছে।
মিসির আলি একটু অস্বস্থি বোধ করলেন। শেষে তিনি নিজেই নিরবতা ভংগ করলেন- আপনাদের গ্রামটা অনেক সুন্দর। আমার ভাল লেগেছে।
ইউনুস সাহেব চোখ তুলে একটু মিসির সাহেবের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেললেন। বললেন- জ্বী, ঠিক বলেছেন স্যার।
আবার নিস্তব্ধতা নেমে এল, মিসির আলি সাহেব এবার সত্যি সত্যি অস্বস্থিতে পড়ে গেলেন। তবে এইবার নিরবতা ভংগ করলেন ইউনুস সাহেব- “স্যার, আমি আপনার কথা অনেক শুনেছি, আপনি অনেক বিজ্ঞলোক এটা আমি জানি। আমার একটা সমস্যা আছে।
মিসির আলি এবার নড়ে চড়ে বসলেন, একটা বেনসন ধরালেন তিনি। তারপর বললেন- হ্যাঁ, অবশ্যই বলুন। আমি শুনছি।
ইউনুস সাহেব একটা পুরাতন ছবি দিলেন মিসির আলিকে। তিনি ছবিটা নিয়ে মোমের আলোতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। একজন যুবকের সাদাকাল ছবি। চেহারায় কিছুটা কাঠিন্য আছে যা ইউনুস সাহেবের চেহারায় অনুপস্থিত।
ইউনুস সাহেব মাটির দিকে তাকিয়ে শুরু করলেন- এটা আমার বড় ভাইয়ের ছবি। আজ থেকে ঠিক বত্রিশ বছর আগের, তার নাম ইউসুফ। আমার থেকে তিন বছরের বড়। আমাদের দুই ভাইয়ের মদ্ধে অসম্ভব মিল ছিল। আমি বয়স তখন বিশ কি একুশ বছর। আমরা দুই ভাই বাপের ব্যবসা দেখাশোনা করি। বাপের বিরাট কারবার ছিল গঞ্জে। রাতের বেলা আমরা দুই ভাই পালা করে দোকানে থাকি। আমার মা অনেক আগেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। বাবা অনেক সখ করে ঐ পাশের বাগান বাড়িটা করেছিলেন।
আমাদের বাড়িতে আমি, আমার ভাই ইউসুফ, বাবা ছাড়াও একজন অন্য মানুষ থাকতো। তার নাম ছিল মনি, আমার এক খালাত বোন। বাপ মা মরা মেয়ে ছিল সে। তাই আমার বাবা ওকে আমাদের বাড়িতে এনে রাখেন। ইচ্ছা মনি বড় হলে তাকে বিয়ে দিবেন। মনির তখন প্রায় সতের আঠার বছর। দেখতে অনেক রুপবতি ছিল মনি। মনি সেই ছোট বেলা থেকে আমাদের বাড়িতে মানুষ, আমরা এক সাথে বড় হয়েছে।
বাবা অনেক দেখে একটা ভাল সমন্ধ ঠিক করলেন মনির জন্য। ছেলেও গঞ্জে ব্যাবসা করে। বিয়ে প্রায় ঠিক তখন।
সে দিন এমন এক বৃষ্টির রাত। আমি গঞ্জের দোকানে। রাতে ঐখানে থাকব। বাইরে অনেক ঝড়। দোকানে আমি একা থাকি। রাতের বেলা সব কর্মচারীর ছুটি থাকে। গঞ্জ থেকে আমাদের বাড়ি প্রায় ৩ কিলো দূরে।
সেই রাতেই মনি আমার বড় ভাই ইউসুফের সাথে পালিয়ে গেল। বুঝলাম ভাইয়ের সাথে মনির মন দেওয়া নেওয়া ছিল অনেক আগ থেকেই।
মিসির সাহেব, আপনি কি আমার কথা শুনছেন?
মিসির আলি তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। কিছু প্রশ্ন এসেছে মনে- এই যেমন, ইউনুস সাহেব বললেন যে তাদের দুই ভাইয়ের মদ্ধে অনেক মিল ছিল তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই বড় ভাইয়ের প্রনয়ের কথা তার আগে থেকেই জানার কথা! যাই হোক, মিসির আলি আর প্রশ্ন করলেন না। তিনি একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন- হু, বলেন আমি শুনছি।
মিসির আলির সাড়া পেয়ে ইউনুস সাহেব আবার শুরু করলেন- “আমার বাবা তখন ছেলের জন্য পাগল প্রায় হয়ে গেলেন, আমার বাবা অতি ভাল মানুষ ছিলেন। ভাই যদি বলত যে ও মনিকে বিয়ে করতে চায় তাহলে বাবা নির্দিধায় রাজি হয়ে যেতেন কোন ভুল নাই। বাবা তখন ব্যাবসা বাণিজ্য পুরা ছেড়ে দিলেন। সারাদিন বাগান বাড়িতে থাকেন একা একা। আমি তখন ব্যবসা চালাই। আমরা অনেক জায়গায় লোক পাঠিয়েছি তাদের খোঁজে কিন্তু ওদের পাইনি কোথাও। এভাবে প্রায় বছর খানেক চলে গেল।
একদিন সন্ধ্যায় বাবা আমাকে বাগান বাড়িতে ডেকে বললেন, “আমি সপ্নে দেখেছি তোর ভাই আর মনি আর এই দুনিয়াতে নাই। ওরা দুজন আমাকে ডাকছে। আমার সময় বুঝি শেষ হয়ে গেলরে বাপ”, বলে কান্নাকাটি শুরু করলেন।
আমি তেমন গুরুত্ব না দিয়ে দোকানে চলে গেলাম। পরদিন সকালে বাবার মৃত দেহ পাওয়া গেল বাগান বাড়ীর পুকুরে! রাতের বেলা যে কোন কারনে হোক বাবা পুকুরে নেমেছিলেন তারপর আর উঠে আসতে পারেন নি।
মিসির আলি এইবার একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলেন না- “কোন থানা পুলিশ হয়েছিল?
ইউনুস সাহেব একবার চোখ উঠিয়ে আবার নামিয়ে ফেললেন। বললেন- আসলে তখন তো থানা এত কাছে ছিল না, পুলিশে খবর দিতে অনেক সময় লাগত, তা প্রায় আট দশ ঘণ্টার পথ ছিল সেটা। তাই গ্রামের ইমাম সাহেব সহ আমরা লাশ দাফন করে দেই। জানেন তো মৃত দেহ বেশি সময় মাটির উপরে রাখা ঠিক না, এটা মৃতের আত্মা কষ্ট পায়।
মিসির আলি সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে দিলেন, বললেন- হুম সেটা জানি। আচ্ছা ঐ ইমাম সাহেব কই আছেন এখন যিনি আপানার বাবাকে দাফন করেছিলেন?
ইউনুস সাহেব বললেন- ঐ ইমাম ভিনদেশি মানুষ ছিলেন, ওনার বাড়ি ছিল রংপুর, তিনি একদিন রাতে কাউকে কিছু না বলে চলে যান, ওনার বাড়ির ঠিকানা আমাদের কারো জানা ছিল না। উনিও আর কোনদিন ফিরত আসেন নি।
মিসির আলি বললেন- আচ্ছা খুব ভাল, তারপর?
ইউনুস সাহেব বললেন- পরপর আমার তিনজন পরিবারের মানুষকে হারিয়ে আমি একটু বিবাগি হয়ে যাই। ব্যাবসা বাণিজ্য ছেড়ে দেই কর্মচারীদের উপর, আমিও বাবার মত ঐ বাগান বাড়িতে আশ্রয় নেই। সারাদিন সারারাত ওখানেই থাকতাম। আমার খুব মন খারাপ হতো, আমি বাবা বাবা করে কাঁদতাম। এভাবে কত দিন গিয়েছিল জানি না হটাৎ এক গভির রাতে আমি বাগান বাড়ির বারান্দায় বসে ছিলাম। তখন শীত কাল। বাইরে তখন ঘন কুয়াশা, কুয়াশার কারনে আকাশের চাঁদ দেখা যায় না ঠিক মত। আমি কাঁদছি। হঠাৎ দেখি সেই কুয়াশা ভেদ করে একজন মানুষ এসে দাঁড়াল আমার সামনে। অন্ধকার আর চাঁদের আলোর লুকচুরির কারনে লোকটাকে বুঝা যাচ্ছে না, তবে এটুকু বুঝতেসি লোকটির সারা শরীর পানিতে ভেজা!
আমি অবাক হয়ে গেলাম, কারন এ দিকে শীত অনেক বেশি পড়ে আর এই শীতের রাতে কেউ একজন খালি গাঁয়ে মাত্র একটা লুঙ্গি পরে থাকতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করার মত না।
আমি বললাম- কে? কে ওখানে?
লোকটা জবাব দিল- আমি তোর বড় ভাই ইউসুফ, তুই আমার সাথে আয়। বলে লোকটা উল্টো হাঁটা দিল। আমার মনে তখন অনেক আনন্দ! আজ এত বছর পরে আমার ভাই এসেছে!! ভাইকে পাবার আনন্দে তখনকার অস্বাভাবিক ব্যাপার গুলো চোখে পড়ল না। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত হাঁটা ধরলাম ভাইয়ের পিছে পিছে।
দেখি আমার ভাইটি বাগান বাড়ির গাছের ফাক দিয়ে আস্তে আস্তে পুকুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমিও গেলাম। দেখি ভাই আস্তে আস্তে হিম শীতল পানিতে গলা পর্যন্ত নেমে গেল। আমি পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম।
আমার ভাই তখন আমাকে বলল- “ইউনুস, আমি ফিরা আসছি।
আমি বললাম- ভাই এদ্দিন তুমি কই ছিলা?
ভাই আমার কথার জবাব না দিয়ে বলল- “ইউনুস, আমি আর মনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার পরে একটা রাস্তায় আমাদের ডাকাত ধরল। তারপর ওরা আমাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিল আর মনিকে কোথায় যেন নিয়ে গেল। সেই থেকে আমি পানি ছাড়া থাকতে পারি না। আমি এখন থেকে এই পুকুরেই থাকব।
আমার তখন ভয়ে হাত পা বরফ হয়ে গেছে। আমি একটা ঢোক গিলে বললাম- মরে গেছ মানে কি?
ভাই একটু খন খনে গলায় বলল- মরে গেছি মানে মারা গেছি। ইন্তেকাল করছি। এইবার বুঝচস?
আমার তখন অবস্থা খারাপ। আমি কোনমতে বললাম- আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার যতদিন ইচ্ছে থাকবা। সমস্যা নেই।
ভাই হেসে বলল- তুই ভয় পাইস না, আমি তোর কোন ক্ষতি করব না, তুই শুধু আমি যা যা বলি তাই করবি। এই পুরো বাগান বাড়ির পাশে দেওয়াল তুলে দিবি যেন কেউ না আসতে পারে, আর এই পুকুরের পশ্চিম পাশে একটা পাকা ঘাটলা তুলে দিবি। আমি রাতের বেলা ওখানে বসে আরাম করব। আর শোন আমার কথা কাউকে বলবি না যেন, নাহলে তোর ক্ষতি হবে আর যাকে বলবি তাকে আমি মেরে ফেলব আমার নিজের জন্য। মনে থাকে যেন।
আমি বললাম ঠিক আছে ভাই। তারপর আমি পুরো বাগান বাড়ির চারপাশে দেওয়াল তুলে উপরে কাচের টুকরা দিয়ে দেই। আর একটা সুন্দর শান বাঁধানো পাকা ঘাটলা তৈরি করে দেই।
মিসির আলি এবার একটু নড়ে বসলেন। হুম। খারাপ না। ভাল একটা গল্প। যদিও অনেক ফাক ফোঁকর আছে। তবুও গ্রামের একজন সামান্য ব্যাবসায়ি এত সুনিপুনভাবে গল্প ফাঁদতে পারেন তবে বলতে হবে লোকটির মেধা অনেক!
মিসির আলি বললেন- আপনি এই ঘটনা কাউকে বলেছিলেন?
ইউনুস সাহেব বললেন- হু, একজনকে বলেছিলাম, আমাদের গ্রামের স্কুলের অঙ্কের মাস্টার, উনি বললেন ঠিক আছে আমি একরাত পুকুর পাড়ে থাকব, পরদিন সকালে অনাকে মৃত অবস্থায় পুকুরের পানিতে ভাসতে দেখা যায়।
মিসির আলি বললেন- তো আপনি আমার কাছে আসলে কি চাচ্ছেন?
ইউনুস সাহেব একটু কেশে নিলেন। তারপর বললেন- দেখেন মিসির সাহেব, আমি গ্রামে থাকতে পারি কিন্তু আমি বি এ পাশ করেছিলাম সেই সময়ে। আমি দেশি বিদেশি লেখকের অনেক বই পড়ি, সেই সুবাদে আপনারও কয়েকটা বই পড়েছি। আমি জানি আমার ধারনা আমি ঐ পুকুর পাড়ে এক ধরনের হেলুসিনেশান হয়।
হঠাৎ যেন ইউনুস সাহবের গলা কেঁপে উঠল- আমি চাই আপনি আমার এই রোগের চিকিৎসা করে দিবেন, আমি সুস্থ হতে চাই!
মিসির সাহেব কিছু বললেন না। তার মাথায় অনেক কিছু চিন্তা চলছে।
তারপর মিসির সাহেব বললেন- ঠিক আছে, আপনি ঘুমান। আমি কাল ঐ বাগান বাড়িটা দেখব আর কাল রাতে আমি ওখানে থাকব।
পরের দিন মিসির আলির অনেক ব্যস্ত একটা দিন গেল। সারাদিন বৃষ্টি ছিল। তবুও উনি সেদিন গ্রামে মসজিদে গেলেন। মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে কথা বললেন। গ্রামের কয়েকজন বৃদ্ধ মানুষের সাথে কথা বললেন। দুপুরে গেলেন থানায়। চেষ্টা করলেন কিছু তথ্য জোগাড় করার। একটা অদ্ভুত তথ্য পেলেন তিনি- বাগান বাড়ির ঘাটলা বানানোর জন্য মাত্র একজন লোক রেখেছিলেন ইউনুস সাহেব! আর ঐ লোকটিও ঘাটলার কাজ পুরোপুরি শেষ হবার আগে মারা পড়ে, তার লাশও পাওয়া যায় ঐ পুকুরের পানিতে! এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কেন ইউনুস সাহেব গোপন করলেন বুঝতে পারলেন না মিসির আলি।
বিকেলে যখন ইউনুস সাহেবের বাড়ি ফিরলেন তখন মিসির সাহেব পুরা কাক ভেজা হয়ে গেছেন। শরীর গরম হয়ে আসছে। জ্বর জ্বর ভাব।
ইউনুস সাহেবও জ্বরে পড়েছেন। প্রায় একশ দুই ডিগ্রির মত।
মিসির আলি একটা ফ্লাক্সে কিছু চা আর এক প্যাকেট বেনসন নিয়ে ইউনুস সাহেবকে বললেন “আমাকে আপনার বাগান বাড়িতে রেখে আসুন, আমি আজ রাতে ওখানে থাকব”।
ইউনুস সাহেব মিসির আলিকে বাগান বাড়িতে নিয়ে গেলেন। মূল ফটকে বিশাল লোহার গেট। গেটে এত বড় এক তালা। সেই তালা খুললেন ইউনুস সাহেব। মিসির আলি অবাক হয়ে দেখলেন গেটের চাবি ইউনুস সাহেবের কোমরে একটা কাল সুতা দিয়ে আটকানো, এবং সেখানে মাত্র একটাই চাবি! বুঝতে পারলেন এই চাবি তিনি এক মিনিটের জন্যও হাত ছাড়া করেন না।
মিসির আলিকে বাগান বাড়িতে রেখে ইউনুস সাহেব চলে গেলেন বাড়িতে। যাওয়ার সময় মিসির আলি খেয়াল করলেন ইউনুস সাহেব জ্বরে কাঁপছেন।
রাত আটটা।
মিসির আলি পুরা বাগান বাড়ি দেখা শেষ করলেন মাত্র। এত বড় বাগান বাড়িকে পুরা মৃত নগরির মত মনে হচ্ছে। অনেক আগাছা আর শুকনো পাতায় ভরে আছে জায়গাটা। কতগুলো দিন এখানে মানুষের আনাগোনা নেই ভাবতেই একটু বিস্ময় অনুভব করলেন তিনি।
আকাশে এখন কাল মেঘের খেলা। এই আসছে এই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আকাশের মেঘ ফুঁড়ে পূর্ণিমার চাঁদ উকি মেরেই আবার লুকিয়ে যাচ্ছে।
মিসির আলি আগে থেকেই একটা ছাতা আর একটা চেয়ার নিয়ে রেখে আসেছিলেন পুকুর পাড়ে, শান বাঁধানো ঘাটলার ঠিক অপরপাশে।
মিসির আলি পুকুর পাড়ে গিয়ে চেয়ারে বসলেন। কাঁধের উপর ছাতাটা ফেলে এক কাপ চা নিলেন। চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরালেন।
বর্ষাকালে চারপাশে বেঙের ডাকে মুখরিত থাকে, তবে এই পুকুরে কোন বেঙ-এর ডাক শুনতে পাচ্ছেন না তিনি। অবাক করা বিষয়! ব্যাপারটা কেমন ভৌতিক মনে হল।
মৃদু হেসে দিলেন মিসির আলি। তিনি ভূতে ভয় পান না, তবে সাপ খোপে ভয় পান। তাই তিনি মাটি থেকে চেয়ারে পা তুলে নিলেন। শুরু হল অপেক্ষার পালা। তিনি কোন আলো জ্বালাননি। শুধু পকেটে একটা ছোট টর্চ রেখেছেন।
ইউনুস সাহেবের ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছেন মিসির আলি। তিনি একটা সাধারন মানসিক রোগে ভুগছেন। এই রোগের রোগিরা নিজেদের চারপাশে এক ধরনের আলাদা জগত তৈরি করে নেয়। সে জগতে দ্বিতীয় কোন সত্ত্বার প্রবেশ নিষিদ্ধ।
যে খুন গুলো হয়েছে এই পুকুরে সেগুলো একদিক থেকে দেখলে খুবই সাধারন খুব হতে পারে, এতে কোন রহস্য নাই।
যেমন স্কুল মাস্টার খুব সাধারন একজন মানুষ ছিলেন, পরকালে ভয়ানক বিশ্বাস করেন তিনি। এই তথ্যগুলো মাস্টার সাহেবের বাড়ির লোকজন থেকে জেনেছেন মিসির আলি। হয়ত ইউনুস সাহেবের গল্প তার মনে দাগ কাটে, রাতে এই নির্জন বাগান বাড়িতে বেড়াতে এসে তিনি হেলুসিনেশানের জন্য কিছু একটা দেখেন। তারপর পুকুরে লাফিয়ে পড়েন। মাস্টার সাহেব সাঁতার জানতেন না, তাই সহজেই মারা যান।
ইউনুস সাহেবের বাবার ক্ষেত্রেও একই ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। বৃদ্ধ মানুষ ছিলেন উনি তার উপরে পুত্র শোক। তাছাড়া অনেকদিন একা একা এই নির্জন বাগান বাড়িতে থাকার কারনে উনিও একধরনের মানসিক সমস্যায় পড়েন।
মসজিদের হুজুর হয়ত সত্যি সত্যি দেশের বাড়ি চলে গেছেন।
ইউনুস সাহেবের এই রোগ সারাতে হলে প্রথমে প্রমান করতে হবে যে তার ধারনা ভুল, তিনি কোন মৃত ভাইকে দেখেননি। কাল সকালে যখন মিসির আলি অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরবেন তখনই একমাত্র তাকে বিশ্বাস করান যাবে।
মিসির আলির এই একটা গুন খুব ভাল, সব সমস্যা আগে সবচাইতে সহজ সমাধান ধরে উনি শুরু করেন। সহজ সমাধান থেকে আস্তে আস্তে জটিলের দিকে যান, এভাবে শুরু করলে কোন পয়েন্ট মিস করবার সম্ভাবনা কম থাকে।
রাত অনেক হল। প্রায় একটা বাজে। মিসির আলি বসে থেকে থেকে কোমর ব্যাথা করে ফেলেছেন। তিনি একটু নড়ে বসলেন। বৃষ্টি অবিরাম ঝরছে, টিপ টিপ শব্দে। পুকুরের পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে এক চমৎকার শব্দ করছে। মিসির আলি মুগ্ধ হয়ে শুনছেন সেই শব্দ।
এমন সময় পুকুরের পানিতে কিছু একটা আলোড়নের শব্দ শোনা গেল, মিসির আলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন পুকুরের দিকে। কই? নাতো কিছু না, হয়ত কোন বড় মাছ শব্দ করেছে। মিসির আলি ভাল করে খেয়াল করলেন। এই তো এই তো কিছু একটা নড়ছে পুকুরের ঠিক মধ্যখানে! অন্ধকারে ভাল বুঝা যাচ্ছে না।
জিনিসটা আস্তে আস্তে শান বাঁধানো পুকুরের ঘাটলার দিকে এগিয়ে আসছে! মিসির আলি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না!
কেউ একজন মিসির আলির মাথার ভিতর থেকে আর্তনাদ করে চিৎকার করে বলে উঠল- পালাও, মিসির আলি পালাও!!

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার-মাঝে মাঝে খানিকটা কৃত্রিম আলোক। ঝিঁঝিঁ পোকার কৃত্রিম ডাক। আর কোন সাড়াশব্দ নেই- এমন একটা পরিবেশে অনেক দূর থেকে শোনা গেল -”লাইট -ক্যামেরা- অ্যাকশন”। আমি যেখানে শুয়ে আছি সেখানে শোয়ানো আছে আমার মত আরো তিনজন অভিনেতা। আমি সহ মোট অভিনেতা চারজন। এই হরর ফিল্মটার শুটিং হচ্ছে এফডিসিতে- চার নম্বর ফ্লোরে। আমি নতুন অভিনেতা। এর আগে মাত্র একটা হরর ফিল্মে অভিনয় করেছি মাত্র- তাও একটা লাশের ভুমিকায় মিনিট খানেক এর অভিনয়। আমি কোন কাজ ও পাচ্ছিলাম না মনের মত। আমি এর আগের অভিনয়ের জন্য বেশ ভাল একটা রোল পেয়েছিলাম। কিন্তু গোলমাল বাঁধে একদম শেষ এ গিয়ে। আমি ভুল করে লম্বা একটা শর্টের একদম শেষ তিন সেকেন্ড এর আগে শ্বাস নিয়ে ফেলি। কেঁপে ওঠার জন্য আমার এই শর্টটাই বাদ দিয়েছিলেন আগের ছবির পরিচালক- কারন এর আগে প্রায় ১০ মিনিটের শর্ট নেইয়া হয়ে গিয়েছিল এবং তাতে খরচ হয়ে গিয়েছিল প্রায় দুই লাখ টাকার কাছাকাছি। তাই আমাকে একদম একটা বাজে মরা র পার্ট করতে দেন করুনা করে। এই একটা পার্টের জন্য আমাকে বর্তমান ছবির পরিচালক এর কাছে ধরনা দিতে হয়েছে অনেক বার। হাতে পায়ে ধরে টাকা না নেবার শর্তে আমি রাজি হই এই মরার ভুমিকায় অভিনয় করতে। কোন কারনে আমার ভুল হলে টাকা দেবেন না আমাকে এই শর্তে আমি এখন শুয়ে আছি এই ফ্লোরের নকল স্টেজ এর একপাশে একটা কফিনের সাথে হেলান দিয়ে।

অনেক বার অনুরোধের পর এই রোল আমি পেলেও এতে অনেক রিস্ক ছিল। কারন আমার শরীরে একটা ইঞ্জেকশন নিতে হয়েছে আমার সকল পেশিকে ঘণ্টা খানেক এর জন্য অলস করে দেবার জন্য। এই ইঞ্জেকশন নেবার পর প্রায় মিনিট বিশেক কেটে গেছে। এর মাঝে আমার হার্ট বিট কমে দাড়িয়েছে মোটে ৩০ এর ঘরে। খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছি আমি। নিচ্ছি না- নিতে বাধ্য হচ্ছি। কারন আমি মরার মত পড়ে আছি চারটা ক্যামেরার সামনে। শর্ট টেক শেষ হলে ই আমাকে আরেকটা ইনজেক্ট করে ঠিক করে দেয়া হবে- এমনটাই বলেছেন ছবির পরিচালক ইসহাক সাহেব।আমি প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম-কিন্তু শেষে চিন্তা করলাম- অনাথ পরিবারের সন্তান আমি – কিছু টাকা পেলে এই মাসটা কিছুটা শান্তিতে কেটে যাবে। কাজটা না পেলে আমার আগের খারাপ রেকর্ডের কারনে আমাকে না খেয়ে থাকতে হবে প্রায় সারা মাস। এর চেয়ে কয়েক ঘণ্টায় হাজার দশেক টাকা পাওয়া যাবে ভেবে এই লাশের ভুমিকায় আমি পড়ে আছি। দেখতে হয়তবা সত্যিকারের লাশের মতই লাগছে আমাকে।

শর্ট টা ছিল এরকম যে কিছু লাশ পড়ে থাকবে এদিক সেদিক। একটা টেবিলে অনেক গুলো অস্ত্র থাকবে- যেমন চাপাতি ছুড়ি ইত্যাদি। এর মাঝে একজন কসাই এসে লাশ গুলো কাটতে শুরু করবে। আমাকে ইসহাক সাহেব অভয় দিয়েছিলেন এই বলে যে এই কসাইয়ের ভুমিকায় তিনি নিজে অভিনয় করবেন। উনি আমাকে কথাটা বলে উপরে বেশ গর্ভবোধ করলেও ভেতরের খবর হল -ডামি হলেও কোন লাশের হাত পা কাটতে কোন কেউ রাজি হয়নি। উনার বাজেট ও এমন নেই যে কেউ সাধে এসে রাজি হবে। আমার মতই তিনি ও খরচ বাঁচাতে নিজেই অভিনয় করতে যাচ্ছেন। উপরে উপরে খুশি হলে ও ভেতর ভেতর কেমন যেন ভয় পাচ্ছিলাম-কারন শক্তিমান অভিনেতা শাকিল খান পর্যন্ত এই ছবিতে অভিনয়ের অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন এতে বাজেট খুব কম বলে।আর শাকিল খানের মত অভিনেতার কি দায় পড়েছে যে উনি একটা কসাইয়ের ভুমিকা করবেন- তাও সব অখ্যাত মানুষের ভিড়ে? তাই কাউকে রাজি করাতে না পেরে শেষে নিজেই শুরু করলেন অভিনয় পরিচালক ইসহাক সাহেব।

অ্যাকশন শব্দ শোনার কিছুক্ষন পর অভিনয়ের এলাকায় প্রবেশ করল কসাই।কিন্তু ইহসান খান কে ছাপিয়ে গেছে কসাইয়ের অভিনয়। আর মেকআপ এত ভাল হয়েছে যে আমি ই চিনতে পারছিনা। বয়স এক লাফে ৪৫ থেকে নেমে এসেছে ২৫ এর কোঠায়। আমি আগেই বলে রেখেছিলাম ইহসান খান কে যে আমি লাশের ভুমিকায় অভিনয় করলে ও চোখ খোলা রাখবো। প্রথমে গাইগুই করলেও পরে রাজি হন তিনি দুই ডোজ ঔষধ ইঞ্জেকশন দেবেন এই শর্তে। মেকআপ রুম থেকে লাশের মেকআপ আর কস্টিউম পড়ে যখন উনার রুমে গেলাম তখন উনি মাত্র মেকআপ নিচ্ছেন। আমি যাওয়ার পর তিনি নিজেই আমার হাতে ইনজেকশন দিলেন। এটা পুশ করা মাত্রই মনে হয়েছে আমার শরীরের একটা পেশী ও কোন কাজের না। সব যেন একটা একটা করে ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই থেকে আমি শুয়ে আছি এই কাঠের বাক্সের উপর। কোনরকমে চোখ মেলে তাকাতে পারছি। মস্তিষ্ক কাজ করছে-কিন্তু অনেক কিছু বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। কানে ভালই শুনতে পারছি। বস্তুতই একটা লাশের মত অবস্থা আমার।তিনজন লোক আমাকে ধরে এই খানে শুইয়ে দিয়েছে। এরপর শুরু হয়েছে ক্লান্তিকর অপেক্ষা।

ভৌতিক পরিবেশ বেশ ভালভাবেই জমিয়েছে ইহসান খানের স্টেজ শিল্পীরা। চারপাশে ধোয়া ধোয়া অন্ধকার। একটা হালকা আলো ছড়িয়ে পড়েছে আমি সহ তিন লাশের ডামির উপর। আর কোন আলো ছিলনা। আর এখন আরেকটা লালচে আলো এখন ইহসান খানের উপর। ইহসান খানের পোশাকটা ও সেই রকম ভয়ঙ্কর। মনে হচ্ছে কোন এক ইংরেজি মুভি থেকে ঊঠে এসেছেন মৃত্যুপুরীর কসাই।বেশ পরিণত মেকআপ। আমি ও চিনতে পারছিনা ভাল মত। সেটে এসেই ইপুন অভিনয় শুরু করে দিয়েছেন। একটা টেবিলের উপর সাজানো ছিল নানা রকম অস্ত্র ও সরঞ্জাম। সেখান থেকে একটা চাপাতি তুলে নিয়ে নিখাদ কসাই এর মত ধার পরীক্ষা করলেন চোখ দিয়ে। তারপর টেবিলে রাখা একটা ডামি র পায়ের নিচ দিক থেকে কাটতে শুরু করলেন। বাহ কি নিপুন অভিনয়। যেন ইহসান খানের জন্মই হয়েছে কসাই এর ভুমিকায় অভিনয় করার জন্য।

সেটে সুনসান নিরবতা। শুধু কসাই এর একটানা থপথপ মাংস কাটার শব্দ শোনা যাচ্ছে। টেবিলের উপর রাখা একটা কাটা পা কে কেটে পাঁচ টুকরা করলেন কসাই সাহেব।যে এই হাড় বানিয়েছে তার জুড়ি মেলা ভার।আমি দশ হাত দূর থেকে হাড়ের সাদা অংশ আর চুইয়ে পড়া রক্তের মাঝে লালচে মাংস দেখতে পাচ্ছি। আজ থেকে ইহসান সাহেব কে এই নামেই ডাকবো আমি। অন্তত আমি এই অভিনয় করতে পারতাম না। একবার ও কাট না বলে এভাবে একটানা অভিনয় করা সহজ কথা না।

উফ আর পারলাম না। চোখের পাতা নবম বারের মত বন্ধ করে আবার খুললাম আমি। এবং সাথে সাথে ভয়ঙ্কর ভাবে কসাই আমার দিকে তাকাল। এই প্রথম মনে হল এই চোখ ইহসান খানের চোখ নয়। আমি ইহসান সাহেব কে ভালভাবেই চিনি। ইনি ইহসান খান হতেই পারেন না। হয়ত অভিনয়ের আগে উনি আরেকজন অভিনেতা পেয়ে গেছেন। কিনবা অন্য কোন মানুষ চলে এসেছে সেট এ। আমার দিকে খানিক টা তাকিয়ে থপ থপ করে আমার সামনে এসে আমাকে পাজকোলা করে নিয়ে গেল ফেলল বড় টেবিলটার উপর। তারপর একটা ছুড়ি দিয়ে আমার গায়ে পড়া টিশার্ট ছিড়ে ফেলল দুই ভাগ করে। কথা ছিল এরপর একটা ধামা নিয়ে কোপ দেবার আগেই ইহসান সাহেব কাট বলে শর্ট শেষ করবেন। কিন্তু কসাই বাবাজি বোধহয় ভুলে গেছে আমার টিশার্ট কাটার সময় আস্তে করে ছুড়িতে চাপ দেবার কথা। এত জোরে চাপ দিয়েছে ছুড়িতে যে আমি নিজেই বুঝতে পারছি ছুড়ির একটা কোনা লেগে আমার বুকের কাছটায় সৃষ্টি হয়েছে একটা লাল দাগ। আমি বেশ ব্যাথা পেলাম। কিন্তু এই সময় কোনভাবেই শ্বাস নেয়া যাবেনা। তাই মরার মত পড়ে রইলাম আমি। টিশার্ট ছিড়েই হিংস্র একটা হাসি দিল কসাই। শুনেই বুকের ভেতরটা দুপদুপ করে উঠল। তারপর একটা ধামা হাতে নিয়ে ভালমত ধার পরীক্ষা করে একটা হাসি দিল সে। এবং মাথার উপর ধামাটা ধরে কোপদিতে যাবে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়াল কসাই- এবং শর্ট শেষ।

কিন্তু না-কাট শব্দটা কেউ চিৎকার করে আগের মত বল্লনা। কেউ কাট শব্দটা এখন ও বলছেনা। পরিচালক যদি আমার সামনে কসাই এর ভুমিকায় হয় তাহলে সে কেন কাট বলছে না? সে কেন আস্তে আস্তে ধামা নামিয়ে আনছে আমার ডান পায়ের গোড়ালির দিকে? কেউ কাট বলেনি –তাই ক্যামেরা রোলিং করে চলেছে। এবং আস্তে আস্তে ধামাটা নেমে আসছে আমার পায়ের দিকে। আমি বুঝতে পারছি কোন একটা দারুন ভুল হতে চলেছে।কিন্তু আমি মুখ নাড়াতে পারছিনা। আমি কিছু বলে ঊঠার আগেই ধামাটা এসে কোপ বসাল আমার ডান পায়ে। এবং এক কোপে আমার পায়ের একটা অংশ কেটে ফেলল কসাই। উফ তীব্র যন্ত্রনায় আমার মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কেঁপে উঠল। আমার হার্ট বিট বেড়ে গেল প্রচন্ড গতিতে। রক্তের ধারায় ভিজে গেল আমার আরেকটা পা। আমি টের পাচ্ছি গরম তরলের অবিরাম ধারা-বের হয়ে যাচ্ছে আমার শরীর থেকে। কিন্তু আমি আমি কাউকে জানাতে পারছিনা। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে আমার দেহ। আমার দিকে আরেকবার তাকিয়ে আবার ধামা তুলে ধরল কসাই। এবার ধামাটা এগিয়ে আসছে আমার গলার দিকে। আমি শেষ বার নিঃশ্বাস নিলাম প্রাণ ভরে। ঠান্ডা বাতাসে শেষ ছোয়া এসে ভরিয়ে দিল আমার ছটফটে ফুসফুস …

পরদিন আবার শ্যুটিং এর সেট ফেলা হয়েছে এফডিসির পাঁচ নম্বর ফ্লোরে।চার নম্বর ফ্লোরে “তুমি আমার প্রেম” সিনেমার গানের শ্যুটিং হবে। তাই পাঁচ নম্বর ফ্লোরে সেট সাজানোর জন্য টিম প্রস্তুত।“কসাই” ছবির পরিচালক ইহসান খান নিজে এসে বুঝিয়ে দিলেন ডিজাইনার দের কিভাবে সাজাতে হবে।ওদের দেয়া হয়েছে চাপাতি, ধামা সহ অনেক গুলো অস্ত্র। সাথে নকল হাত ,পা, রক্ত ইত্যাদি। একটা কম বয়সী ছেলে আজ এসেছে এখানে সেট সাজাবার জন্য। সে এক মনে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে একটা কাটা মাথার দিকে। প্রথমে চিনতে পারেনি। কিন্তু পরে চিনেছে এটা নতুন অভিনেতা নিয়াজ মোরশেদ এর মত। যেই বানিয়েছে অবিকল বানিয়েছে। গতমাসে নিয়াজ মোরশেদের সাথে প্রথম দেখা। একটা পার্ট দেবার জন্য অনেক ধরেছিল। তাই ইহসান খানের কাছে নিয়ে গিয়েছিল সে। এই কথা গুলো ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে গিয়েছিল সে- হটাত ইহসান সাহেবের ধমক খেয়ে মাথাটা টেবিলের উপর রেখে আবার কাজে মন দিল সে। এরপর কাটা হাত পা গুলো আংটা দিয়ে দেওয়ালের সাথে ঝুলাতে ব্যাস্ত হয়ে গেল সে …

রাত বেশি নয়,নয় টা সাড়ে নয় টা হবে হয়তো

রাত বেশি নয়,নয় টা সাড়ে নয় টা হবে হয়তো।আমরা পাঁচজন বন্ধু মিলে সুন্দরবনের দুবলার চড়ে গর্জন গাছের নিচে বসে গল্প করছিলাম।অন্ধকার রাত।খুব ঠান্ডা বাতাস।নানান গাছের পাতার সর সর শব্দ।চা খাচ্ছি,সিগারেট খাচ্ছি,এলোমেলো বিভিন্ন কথাবার্তা বলছি।আজ সন্ধ্যায় আমরা সুন্দরবনে এসে পৌছেছি।হঠাৎ সুমন বলল,এক মাইল দূরে একটা ভূতের বাড়ি আছে,অনেক আগের পুরোনো ভাঙ্গা বাড়ি।সুন্দরবনের আশে-পাশে যারা থাকেন,তারা বলেন বাড়িটা ভূতের।অনেকে বন থেকে মধু ও কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে যারা কৌতুহলে এ বাড়ির কাছাকাছি গিয়েছে তারা আর ফিরে আসতে পারেনি।এই যুগে কেউ ভূতের কথা বললেই আমার খুব রাগ হয়।মুহূর্তের মধ্যেই আমি ঠিক করে ফেললাম ভূতের বাড়িতে আমি যাবো।মানুষের থাকার জায়গা নাই আর ভূতের বাড়ি!ফাজলামো!আমরা সবাই মিলে দুই ঘন্টা হেঁটে সেই ভূতের বাড়ি খুঁজে বের করি।তখনও রাত বারোটা বাজেনি।

দোতালা ভাঙ্গা বাড়ি।কোনো দরজা জানালা নেই।যেন পুরো বাড়িটা গাছ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।শ্যাওলা পড়া,ইটের ফাঁকে ফাঁকে বড় বড় গাছ হয়েছে।।সবাই নিচে থাকবে,আমি একা উপরে যাবো।কারণ আমার সখ বেশি।যদি ভূত আমাকে মেরে ফেলে তাহলে আমার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।ওদের নানান শর্ত আমি সব মেনে নিলাম।অনেকক্ষন বাড়ির চার পাশ দিয়ে ঘুরেও,বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার কোনো দরজা খুঁজে পেলাম না।চারিদিকে প্রায় সাত ফুটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা এবং দেয়ালের উপর তারকাটা ও ভাঙ্গা কাঁচ বসানো।

ওদের সবাইকে নিচে রেখে আমি উপরে উঠলাম।বন্ধুরা সাহায্য না করলে সাতফুটের দেওয়ালে একা ওঠা সম্ভব হতো না।ভাঙ্গা কাঁচে হাত কেটে গেল অনেকখানি।অনেক ঝামেলা করে দোতালায় উঠলাম জানালা দিয়ে।বন্ধুরা সবাই আমার অপেক্ষায় আছে।দোলায় তীব্র অন্ধকার,কিছুই দেখা যায় না।আমি খুব ধীরে ধীরে এক রুম থেকে অন্য রুমে যাচ্ছি।ছাদে ওঠার সিঁড়ি খুঁজে পাচ্ছি না।কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ খুব ভয় পেলাম।অনেক ভয় পেলাম।যদিও কোনো ভূত বা অন্য কিছু দেখিনি।শুধু মনে হলো,যেনো আমি অনন্তকাল ধরে এই ঘরে হেঁটে বেড়াচ্ছি।অনেকক্ষন পর বুঝতে পারলাম,আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি।যেদিক দিয়ে দোতালায় উঠেছিলাম সেই পথ খুঁজে পাচ্ছি না।সব ভাঙ্গা দরজা-জানালা গুলো যেনো কোনো কারণে অদৃশ্য হয়ে গেছে।এই ভূতের বাড়ি থেকে আমি আর বেরুতে পারবো না।কে যেনো আমার নাম ধরে একবার ডাকলো।তারপর এক আকাশ নিরবতা।কোনো শব্দ নেই।

আমি খুব সাহসী নই।তবে ভূত প্রেত বিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।খুব সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়ে গেল।প্যাকেটে হাত দিয়ে দেখি সিগারেট আছে কিন্তু ম্যাচবাক্স নেই।খুব রাগ হলো।কার উপর রাগ হলো কে জানে!কি করি কিছুই বুঝতে পারছি না।খুব অস্থির অস্থির লাগছে।হঠাৎ শুনতে পেলাম কারা যেন ফিস ফিস করে কথা বলছে,মেরে ফেলো মেরে ফেলো।আমি চোখ বন্ধ করে বললাম- ঈশ্বর সাহায্য করো,সাহায্য করো।

ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে

যারা ভুত বিশ্বাস করেন না এ লেখাটি তাদের জন্য নয় । কেননা এটা একটি ভুত সংক্রান্ত লেখা বা ঘটনা । যা কিনা আজো আমার কাছে জীবন্ত । এখন ও আমি মাঝ রাত্রিরে জেগে বসে থাকি ভুতের ভয়ে । ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে । কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এইতো সেদিন ঘটলো ঘটনাটি । ঘটনাটির কথা মনে হলে হাত পা আমার এখনও ঠান্ডা হয়ে যায় ।

আমারা তখন পুরানো ঢাকাতে থাকি । বাবা সরকারি চাকুরি করেন । বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করেই আমরা বড় লোক হয়ে গেলাম । তা ও বাবার এক ফুপুর কল্যাণে । বাবার বড়লোক ফুপুর মৃত্যুর পর তার বিষয় সম্পতির ছোট একটি অংশ আমাদের বড়লোক করে দিল রাতারাতি ।

আমারা ভাড়া বাসা থেকে আমরা নিজেদের বাড়ীতে উঠলাম । তাও আবার তিন তলা বাড়ী । ৬টা ভাড়াটিয়াসহ বিশাল বাড়ী । আমরা উঠেছি দোতালায় । সারা দিন ভাই বোনদের সঙ্গে আনন্দ করে সময় কাটে । বাড়ীর সামনে দু’টো বড় বড় মেহগনি গাছ । তার একটিতে ছোটকাকু দোলনা টানিয়ে দেয়াতে আমাদের আনন্দের মাত্রা বেড়ে গেছে কয়েক গুন । সারা দিন হৈই চৈই । বিকেল বেলা সবাই মিলে ছাদে খেলা করতাম । এতো বিশাল ছাদ আমি আগে কখনও কল্পনাও করতে পারতাম না তা আবার নিজেদের । ছাদ সাধারনত মা তালা দিয়ে রাখতেন । শুধু বকেল বেলায় খুলে দিতেন । সন্ধ্যার পর শুধু পড়তে বসতাম । রাতে খাওয়া দাওয়ার পর কাকুর কাছে গল্প শুনতে বসা । কাকু নিত্য নতুন ভূতের গল্প বলে আমাদের ভয় পাইয়ে দিতেন । মাঝে মাঝে মাও আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিতেন । গল্প শেষে মা প্রায়ই হেসে বলতেন । ভুত বলে কিছু নেই ।

দেখতে দেখতে আমার এস এস সি পরীক্ষা চলে এলো । ভাল রেজাল্ট করতে পারলে বাবা রেসিং সাইকেল কিনে দেবো । তাই রাত জেগে পড়া শুনা করছি । ভাল রেজাল্ট করার চাইতে আমার সাইকেলটার দিকেই বেশি মনোযোগ । বাসার সবাই ঘুমিয়ে গেলেও আমি সারা রাত জেগে পড়ি । মাঝে মাঝে ঘরের ভেতর হাটা হাটি করি । বেশি খারাপ লাগলে ছাদে চলে যাই । কাকুর ভাষ্য মতে রাতের একটি ভাষা আছে । তাছাড়া রাতের আকাশ ও আমার দেখতে খুব ভাল লাগে । বিশাল রহস্যময় আকাশের শৈল্পিক কারুকার্য আমাকে সব সময় মুগ্ধ করে ।

(২)

সেদিন ছিল পূণিমার রাত । রাত প্রায় তিনটা বাজে । আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম । বাসার সবাই ঘুম । হঠাৎ ছাদ থেকে ধুপ ধুপ শব্দ ভেসে এলো । বিকেল বেলায় আমরা ছাদে খেললে যেমনটি শব্দ হয় ঠিক তেমনটি । আমি বেশ অবাক হলাম , এতো রাতে ছাদে আবার কে খেলছে !

কাকু আর আমি একই রুমে থাকি । বেশ কয়েকবার শব্দ হওয়ায় কাকুকে ডাক দিলাম । কাকুর উঠার নামটি নেই । নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে । অনেকক্ষন ডাকা ডাকি করার পরে কোন রকম মাথা তুলে বললেন তুই গিয়ে দেখনা কে ?
ইদুর টিদুর হবে হয়তো । বলে কাকু আবার নাক ডাকতে শুরু করলেন । এদিকে ছাদের শব্দ দৌড়া দৌড়ি পর্যায় পৌছে গেছে । আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম আমার তেমন ভয় করছেন । বরং দেখতে ইচ্ছে করছে এতো রাতে ছাদে কে দৌড়া দৌড়ি করছে ।

আমাদের রান্না ঘরের দেয়ালে মা ছাদের চাবি ঝুলিয়ে রাখেন । আমি ঘর থেকে বেড় হয়ে ছাদের চাবি নিলাম । আমাদের ফ্লাট থেকে বেড় হতেই ডান দিক দিয়ে উঠে গেছে ছাদের সিঁড়ি । প্রতিটি বারান্দায় বাতি জ্বলছে । তিন তলার বারান্দা গুরে ছাদের সিঁড়ি । আমি ছাদের সিঁড়িতে উঠার পরও আমার কোন ভয় লাগছিল না । তিন তলা থেকে ছাদের ছাদের দরজা দেখা যায় । বন্ধ দরজা । তালা দেখা যাচ্ছে । তবে ছাদে শব্দ করছে কে ?

আমি ছাদের তালা খুলে ফেললাম । চাঁদের আলোয় ছাদ ভেসে যাচ্ছে । ছাদে বেড় হলেই সামনে রবিন চাচ্চুদের ৪ তলা বাড়ী । রবিন চাচ্চুদের বাসা থেকে আমাদের পুরো ছাদটা দেখা যায় ।

ছাদের এ মাথা ; ও মাথা বেশ ভাল করে দেখলাম কেউ নেই । আমি বেশ অবাক হলাম । তা হলে শব্দ করলো কে ? পানির ট্যেন্কির উপড় দেখলাম । না । কেউ নেই । এবার কিন্তু আমার গা বেশ কেমন ছমছম করছে । আশে পাশের বাড়িগুলোর দিকে বেশ কয়েকবার তাকিয়ে আমি নীচে নেমে এলাম ।

ঘরে এসে ডকডক করে দু গ্লাস পানি খেলাম । এমনিতেই আমি বারবার হিশু পায় বলে রাতেরবেলা পানি কম খাই । কিন্তু সেদিন তেস্টা যেনো আর মিটছিলো না । ২য় গ্লাস পানি শেষ করার মুর্হুতে আবার ধুপ ধুপ শব্দ ভেসে এলো । আমি গ্লেলাসটি রেখে উঠে পড়লাম । ছাদের সিঁড়িতে এসে দেখি ছাদ তালা মারই আছে । দরজা বন্ধ । কিন্তু দরজার ওপাশেই কে যেনো দৌড়াচ্ছে । আমি ভয়ে ভয়ে তালা খুলে ছাদে এলাম । আবারও চাঁদের আলোয় চোখ ভেসে গেলো । আমি পুরো ছাদ বেশ ভাল করে দেখলাম । না । কেই নেই । নিজেকে কেমন বোকাবোকা মনে হলো । নিজেকে শান্তনা দিলাম হয়তো রাত জেগে পড়ার ফলে উল্টা পাল্টা শব্দ শুনছি ।

ছাদ তালা দিয়ে নামার জন্য পেছন গুড়তেই চমকে উঠলাম । হাতের ডান পাশে সিঁড়ির শেষ মাথার ছাদের দেয়াল ঘেষে কে যেনো বসে আছে । ভয়ে আমার বুক তখন হাপারের মতো উঠা নামা করছে । আমি কোন রকম জিজ্ঞষ করলাম । কে ! কে ওখানে ? হালকা আলো স্পষ্ট দেখা যাচ্চে দু’হাটুর মাঝ খানে মাথা রেখে কে যেনো বসে আছে ।
ছোট্র শরীরটা দেখে আট দশ বছরের বাচ্চা বলে মনে হলো । আমি কানে তখন কিচ্ছু শুনছি না ।
চোখেও ভাল করে দেখছি বলে মনে হলো না ।
শুধু তাকিয়ে আছি । আর জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করছি কে ! কে ওখানে ?

বেশ কয়েক বার চিৎকার করতেই সামনে বসে থাকা কায়াটা হাটু থেকে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো । ভয়ে আমি চমকে উঠলাম । জাপানি ভুতের সিনামায় দেখা আট নয় বছরের একটি ছেলে আমার দিকে হাটু থেকে মুখ তুলে তাকালো । বড় বড় দুটো চোখ । সমস্ত মুখ কেমন ফেকাসে হয়ে আছে ।
অনেকক্ষন পানিতে ভিজলে চামড়া যেরকম ফেকাসে হয় তেমনটি ।
আমি আরো জোড়ে চিৎকার করলাম কে কে ?
ছেলেটি কোন উত্তর দিলো না শুধু একটি হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো ।
আমি ভয়ে তখন কি ভাবে যে নীচে নেমে এলাম বলতে পারবো না ।
যখন চোখ খুললাম তখন দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি মা ;বাবা,কাকু আর একজন ডাক্টার আমায় ঘিরে আছেন ।
বাবা কাকুকে বকছেন আমদের কেন ভুতের গল্প শুনায় তার জন্য । মা’র হাতের ফাঁক দিয়ে আমার চোখ যখন দরজার কাছে গেলো তখন আবার চমকে উঠলাম । ছাদে দেখা ছেলেটি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে । আমার চোখা চোখি হতেই । ডান হাতটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো । আমি আবার জ্ঞান হারালাম ।
সে বার আমাকে অনেকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো । কিন্তু আশ্চযের বিষয় সে রাতের পর ঐ ছেলেটিকে আর কোনদিন দেখা যায়নি আমাদের ছাদে দেখা যায়নি। সে রাতে অবশ্য আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল সেটি হলো আমাদের পাশের বাসার রবিন চাচ্চু মারা গিয়েছিলো । ভাল মানুষ হঠাৎ নাকি কি দেখে খুব ভয় পেয়েছিলেন । প্রিয় পাঠক এ দুটো ঘটনার মাঝে কোন মিল আছে কিনা আমি বলতে পারবনা ।আপনারা ভেবে দেখুন ।।

আমি আগাগোড়াই রাজধানীতে বেড়ে উঠা মানুষ

আমি আগাগোড়াই রাজধানীতে বেড়ে উঠা মানুষ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব ঢাকাতেই ছিল। কিন্তু বর্তমানে চাকুরী করছি ঢাকার বাইরে। মূলত ভালো বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার লোভেই এখানে আসা। আমার পরিচিত বলতে এখানে কেউ নেই। বা-মা, বন্ধু-বান্ধব, আত্নীয়-স্বজন সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন আছি গত মাস-চারেক ধরে। প্রথম প্রথম কয়েকদিন খুব খারাপ লেগেছিল। পরিবারের মানুষগুলোর কাছ থেকে কখনো দূরে থাকতে হয়নি বলে তাদের অভাবও কোনোদিন অনুভব করিনি। আসলে মানুষ যখন নিয়মিত কাউকে দেখে, কারো সাথে মেশে…তার অভাব কখনো বোধ করেনা বরং তার নিয়মিত উপস্থিতিই মাঝে মধ্যে একঘেঁয়ে লাগে।

আমাদের কোম্পানীতে স্টাফদের থাকার জন্য একটি আলাদা কোয়াটারের ব্যবস্থা আছে। সমস্যা একটাই, তা হল-এক রুম দুজনকে শেয়ার করতে হয়। আমার রুমমেট হলেন আদিল ভাই। তিনি আমার ডিপার্টমেন্টেই কাজ করেন। আদিল ভাইকে পছন্দ করে এমন একজন লোকও অফিসে নেই। অপছন্দের কারনটা ২-১দিনের মাথায় বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম। উনি কখনোই কোনো কথা সোজা ভাবে বলেন না। প্রত্যেকটা কথার মধ্যে একটা খোঁচা থাকবেই। আকার-ইঙ্গিতে, ভাব-ভঙ্গিতে সবসময় বোঝাতে চেষ্টা করেন যে তার চেয়ে জ্ঞানী এবং দক্ষ লোক এই অফিসে আর কেউ নেই। আর চোখে মুখে সর্বদাই কেমন যেন একটা রহস্যের আঁভা দেখতে পাওয়া যায়। ভাবখানা এমন যে উনি কোনো আধ্যাত্নিক টাইপের লোক। অফিসের মোটামুটি সব কলিগের সাথেই নাকি অন্তত একবার হলেও তার কথা কাটাকাটি হয়েছে। ইদানিং অবশ্য সবাই তাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। আমার এমনই পোঁড়া কপাল যে এই লোকই আমার রুমমেট!


একসাথে একই রুমে থাকলে মানুষের ভীমরতিগুলো খুব চোখে পড়ে। প্রত্যেকটা মানুষেরই অবশ্য কিছু না কিছু ভীমরতি থাকে সেটা মেনে নেয়াই যায় কিন্তু এই লোকের ভীমরতির কোনো শেষ নেই। তাছাড়া মাঝে-মধ্যে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বলেন যে হজম করা খুব কষ্ট হয়ে পড়ে। মোট কথা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে তার সাথে একরুমে থাকা প্রায় অসম্ভব। ৩-৪ দিনের মাথায় আমার নাভিশ্বাস উঠে গেল। আমি অফিসের আর একজন সিনিয়র কলিগ রেহান ভাইয়ের সাথে আমার সমস্যার কথা শেয়ার করলাম। রেহান ভাইয়ের সাথে প্রথম দিন থেকেই আমার একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। উনি জানালেন যে কেউই নাকি আদিলের রুমে বেশিদিন টিকতে পারে নাই। ঐ রুমে নাকি একটা বেড বেশিরভাগ সময় ফাঁকাই থাকে । তবে তিনি আমাকে হুট করে রুম না ছাড়ার পরামর্শ দিলেন। কারন হিসেবে বললেন যে, আদিল মারাত্নক গিরিঙ্গিবাজ ও ঝঁগড়াটে লোক। রুম ছাড়ার মত ছোট একটা ঘটনাকে বিশাল ইস্যু বানিয়ে গ্যাঞ্জাম-ক্যাচাল সৃষ্টি করবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত। আমার মত একজন নতুন ইমপ্লয়ীর জন্য সেটা নাকি মোটেও সুখকর হবেনা।

কিন্তু এদিকে তো আমার জান যায় যায় অবস্থা। মাঝে মাঝে আদিলের উপর মেজাজ এমন খারাপ হয় যে ইচ্ছে করে বাম হাতে একটা থাপ্পর লাগাই। এই তো সেদিন…কথা নাই বার্তা নাই রাত তিনটার দিকে হঠাৎ আমাকে ডাকতেছে, তাও আবার উচ্চস্বরে! আমি তো হুরমুর করে জেগে উঠলাম। উঠে দেখি উনি একটা নিভানো সিগারেট মুখে নিয়ে বসে আছেন। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “”আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? হঠাৎ সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখি ম্যাচ নেই। আপনার কাছে ম্যাচ হবে”?” আমার মেজাজটা এত খারাপ হয়েছিল যে বলার মত না! নিজেকে অনেক কষ্টে সামলালাম। তাকে কোনো উত্তর না দিয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন অফিসে গিয়ে রেহান ভাইকে বললাম, “ভাই আপনি আমাকে এই ভেজাল থেকে উদ্ধার করেন নাহলে আমার চাকরিই ছাড়তে হবে””। আমার কথা শুনে রেহান ভাই কিছুক্ষন হাসলেন। তারপর বললেন, “”আসলে আপনাকে আগে কোনোদিন রুম শেয়ার করতে হয়নি তো তাই আপনি একটু বেশিই বেকায়দায় পড়ে গেছেন। তাছাড়া আপনার ভাগ্যটাও এত খারাপ যে আদিলের সাথেই আপনাকে রুম শেয়ার করতে হচ্ছে। যাকগে টেনশনের কিছু নেই। আপনার একটা ব্যবস্থা আমি করবই””। রেহান ভাইয়ের কথায় আমি আশ্বস্ত হতে পারলাম না। উনি কিইবা ব্যবস্থা করবেন? হয়ত আমাকে একটু সান্ত্বনা দিলেন। হয়ত তিনি ধরে নিয়েছেন কদিন পর আমার এমনিতেই এডজাস্ট হয়ে যাবে। মানুষ পারে না এমন কি কিছু আছে?

এভাবেই আরো বেশকটা দিন পার হয়ে গেলো। আদিলের সাথে এডজাস্ট করা কোনোদিনই সম্ভব হবে না তা আমি ভালোভাবেই জানতাম। পরিবার পরিজন থেকে দূরে থাকায় এমনিতেই মন খুব একটা ভালো থাকে না তার উপর আদিলের মত একটা পেইন! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম…আমার সমস্যার কথা বসকেই জানাবো। তিনি কোনো ব্যবস্থা না করলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবো।

এর মাঝে তিনদিনের টানা ছুটি পেয়ে একদিন ঢাকায় চলে গেলাম। ছুটি কাটিয়ে যখন আবার কোয়াটারে ফিরলাম তখন দেখি আদিল নামক “পেইন”টা নেই। আশেপাশের কলিগদের কাছে জানতে পারলাম সে নাকি ৭দিনের ছুটি নিয়েছে। কথাটা শুনে মনে মনে ঈদের আনন্দ পেলাম। যাক ৭দিন অন্তত মহাসুখে কাটানো যাবে। কিন্তু সেদিন রাতেই ঘটল আমার জীবনে এক স্মরনীয় ঘটনা। বলে রাখা ভালো যে, আমি যে রুমে থাকি তা নিচতলায় অবস্থিত। নিচতলায় মশার উপদ্রপ বেশি বলে কখনোই জানালা খুলে ঘুমাই না। সেদিন কেন জানি মনে হচ্ছিল জানালা খুলেই ঘুমাবো। পরে আবার চিন্তা করলাম…থাক দরকার নেই। দরজা-জানালা সবকিছু লক করা আছে কিনা তা চেক করে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

মাঝরাতে হঠাৎ নিম্নচাপ অনুভব করায় ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। উঠে যা দেখলাম তা দেখে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে যা দেখছি তা ঠিক দেখছি কিনা! ভালো করে চোখ ডলতে লাগলাম। দেখলাম…আদিল ভাইয়ের খাটের উপর যে তোশক এবং চাঁদর ছিলো তা মেঝেতে ফালানো। খাটের এক কোনার দিকে তা স্তুপাকৃতি হয়ে আছে। কিন্তু কে করলো এই কাজ? বাসায় তো আমি একা! চোর ডাকাত ঢুকলো নাতো বাসায়? আমি উঠে দরজা-জানালা সবকিছু আবার চেক করলাম। কই সবই তো ঠিক আছে। চোর ডাকাত ঢুকলে তো দরজা-জানালা ভেঙ্গে ঢুকতে হবে। সব দরজা-জানালা ভিতর থেকে লক করা। তাহলে চোর ঢুকলো কিভাবে? তাছাড়া আমার দুটা দামী মোবাইল সেট, নেটবুক ছাড়াও আরো অনেক জিনিসপত্র আছে বাসায়। চোর ঢুকে থাকলে সেগুলো রেখে যাবে কেনো? তার মানে কি দাড়ালো এটা কোনো ভুত-প্রেতের কাজ?…এছাড়া এই ঘটনার আর কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারলাম না। আমি ছোটবেলা থেকেই ভুত-প্রেতে বিশ্বাস করিনা। কিন্তু এখন চোখের সামনে যা দেখছি তাই বা অবিশ্বাস করি কিভাবে? মনে মনে ঠিক করলাম অন্য কলিগদের এত রাতে আর বিরক্ত করবনা। একটু পরেই তো সকাল হবে তখন সবাইকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলব।

ভোরের আলো ফুটতেই আমি নক করলাম লিমন ভাইদের ফ্ল্যাটে। আমার ঠিক পাশের ফ্ল্যাট। এত সকালে আমাকে দেখে একটু অবাকই হলেন লিমন ভাই। আমি লিমন ভাইকে রুমে নিয়ে আসলাম। পুরো ব্যাপারটা খুলে বললাম। উনি আমার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন…””তার মানে আপনি বোঝাতে চাচ্ছেন এগুলা ভুতের কাজ? দেখেন…আমি এসব অতিপ্রাকৃ্তিক ব্যাপার স্যাপার একদমই বিশ্বাস করিনা। আপনার নিশ্চয়ই কোনো ভুল হচ্ছে। হয়ত আপনি ঠিকমত দরজা লক করে ঘুমান নি। দরজা খোলা ছিল এবং খোলা দরজা দিয়ে কেউ ঢুকে এই কাজ করেছে”।” আমি লিমন ভাইকে বললাম, ““ভাই, আমারও আপনার মতই এরকম কিছু একটা সন্দেহ হচ্ছিল। তাই সবার প্রথমে দরজা খোলা আছে কি না তা চেক করেছি। আর খামাখা তো আমার এরকম একটা নাটক সাজানোর কোনো দরকার নেই, তাই না?”” লিমন ভাই হেসে বললেন, ““আমি কি বলেছি নাকি আপনি নাটক সাজিয়েছেন? তবে আমার মনে হচ্ছে ঘুমের ঘোরে কাজটা আপনিই করেছেন কিন্তু এখন আর মনে করতে পারছেন না”।” লিমন ভাইয়ের কথা শুনে আমার মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেলো। আমি চিৎকার করে বললাম, “”তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি সিজোফ্রেনিক?”” আমার চিৎকার শুনে দেখি রেহান ভাই হাজির। উনি আমার সব কথা শুনে বললেন, “”আচ্ছা আপনি কি নিশ্চিত যে আপনার কোনো কিছুই খোয়া যায় নি? আপনি একটু ভালো করে দেখবেন সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা?”” আমি রেহান ভাইকে বললাম, “”ভাই আপ্নারা কেনো বিশ্বাস করছেন না যে এখানে চোর ঢোকেনি। এখানে অন্যরকম কিছু একটা ঘটেছে”।” রেহান ভাই বললেন…””আপনি এই মূহুর্তে মেন্টাল স্ট্রেসের মধ্যে আছেন। এই অবস্থায় স্বাভাবিক চিন্তা করাটা কঠিন। আমি যা বলি শুনুন। একটু ভালো করে খোজ করুন যে আপনার কিছু খোয়া গেছে কিনা!”” রেহান ভাইয়ের কথা শুনে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ মনে হল যে আমার মানিব্যাগটা চোখে পড়ছে না। তন্ন তন্ন করে সারা রুম খুজলাম কিন্তু মানিব্যাগটা আর খুজে পেলাম না। আমার মনে পড়ল যে কাল রাতে আমি আমার মানিব্যাগটা রেখেছিলাম আদিল ভাইয়ের খাটের উপর। রেহান ভাই বললেন, “”কাল রাতে একটা চোর আমার রুমের জানালাও খোলার চেষ্টা করেছে কিন্তু ভিতর থেকে লক করা ছিল বলে খুলতে পারেনি। আমার অবশ্য সেই সময় চিৎকার করা উচিৎ ছিল তাহলে হয়ত চোরটা পালিয়ে যেত আর আপনার উপর দিয়ে এই শনির দশা যেত না। ভুল হয়ে গেছে। আমি খুবই সরি”।” আমি বললাম…””ভাই আমার জানালাও তো লক করা তাহলে চুরির ঘটনা কিভাবে ঘটল? আমি বা আদিল ভাই তো কখনো জানালা খুলিনা। এই দেখেন এখনো জানালা লক করা”।” রেহান ভাই লক করা অবস্থায় আমার থাই জানালা খোলার চেষ্টা করলেন এবং অবাক বিস্ময়ে দেখলাম জানালাটি খুলে গেলো। রেহান ভাই হেসে বললেন, “”আপনার জানালার লক নষ্ট। চোর ঠিকই জানালা খুলেছে এবং হাত বাড়িয়ে আস্তে আস্তে আদিলের তোশকটি টেনে এনেছে। তার চুরির লক্ষ্যবস্তু ছিল আপনার মানিব্যাগটি যা আপনি ভুলে আদিলের বিছানার উপর রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তবে রসিক চোর চৌর্যকর্ম শেষে জানালাটা টেনে ঠিক আগের অবস্থায় রেখে গেছে। তাই তাৎক্ষনিকভাবে চুরির ব্যাপারটা আপনার মাথাতেই আসেনি”।”

রেহান ভাইয়ের কথা শুনে লিমন ভাই হো হো করে হাসতে লাগলেন। আমাকে টিটকিরির সুরে বললেন, “”ভাই আমি আপনার কথা শুনে কিন্তু একটা সময় বিশ্বাসই করে ফেলছিলাম যে এটা ভুতের কান্ড। আপনি আমার এতদিনের লালিত বিশ্বাস মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রায় ভেঙ্গে ফেলেছিলেন…হাহাহাহাহাহা!”” উনার কথা শুনে আমিও হেসে দিলাম।

রেহান ভাই আমাকে বললেন, “”এখন অফিসে গিয়ে পুরো ব্যাপারটা বসকে জানান। গিয়ে বলেন যে এই রুমে আপনি মোটেও নিরাপদ না। আর দোতালায় জহির সাহেবের রুমে একটা বেড খালি আছে। আপনি বসকে বলে আজকেই সেখানে উঠে যান”।”

আমি বসকে পুরো ব্যাপারটা জানালাম। উনি কোয়াটারটির সিকিউরিটি ম্যাটার নিয়ে খুবই কনসার্ন্ড হলেন এবং পুরো ব্যাপারটার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমি সেদিনই আমার রুম চেঞ্জ করে ফেললাম। সেদিন থেকে আজ অবধি বেশ শান্তিতে আছি। আমি এখন আদিল থেকে মুক্ত। যদিও আমার মানিব্যাগে হাজার পাঁচেক টাকা ছিল এবং বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজ ছিল কিন্তু এটা কোনো ব্যাপারই না। মানিব্যাগটা চুরি না হলে তো আর আদিলের মত মহাপেইন থেকে মুক্ত হতে পারতাম না এত সহজে!

ঘটনার সপ্তাহখানেক পর একদিন রেহান ভাই আমার সেই হারানো মানিব্যাগ আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি অবাক হয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম…”এটা আপনি এতদিন পর কোথায় পেলেন?” উনি রহস্যমাখা একটা হাসি দিয়ে বললেন, “”আমি কিন্তু কথা দিয়েছিলাম যে আপনাকে আদিল থেকে মুক্ত করার একটা ব্যবস্থা করবই”।”